সেবার শিলাদা ডেকেছিল। অ্যান্টেনায়। মানে, পিয়ারলেস হাসপাতালের পিছনের ঠেকটায়। সামনে বসিয়ে বলেছিল, ‘রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করব। আমাদের মতো করে। গোটা সন্ধে রবীন্দ্রনাথের কাজকর্ম নিয়ে যার যা ইচ্ছে হবে করবে। পুরো ব্যাপারটায় তুই অ্যাংকারিং করবি। অনুষ্ঠানের নাম? ‘ইয়ে রাত মুঝে দেদে ঠাকুর।’
হ্যাঁ বলব কী, আমি হেসেই গড়িয়ে পড়েছিলাম। আর ওদিকে ভুরু–টুরু কুঁচকে মুখটা ছুঁচলো করে শিলাদা গম্ভীর গলায় বলে যাচ্ছে, কীঅয়চে, কীঅয়চে... কেসটা সিরিয়াসলি নিচ্চিস না তো?’
শিলাদা এরকমই।
মাস্তান।
বাংলা গানের বেতোয়াক্কা অ্যান্টিসোশ্যাল।
যে বলে দিতে পারে, গান গাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে তাই গাইছি, চেঁচাতে ইচ্ছা করলে চেঁচাতাম। মানুষের আদিমতম এক্সপ্রেশন যে চিৎকার এবং সেই চিৎকার যে আসলে গানের খাঁটিতম পূর্বপুরুষ— সেটা আমাকে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিল শিলাদাই। দেখিয়েছিল, এমনভাবে গান বানানো যায়, এমন এমন ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বা ফলি সাউন্ড গানে ঢোকানো যায়, যাতে গানে কী বলতে চাইছি চোখ বন্ধ করলেই তার ছবি চোখের সামনে ফুটে ওঠে।
হ্যাঁ, শিলাদা কথা দিয়েই ছবি আঁকতে পারে। তা সে ‘হে আমার পরমপিতঃ’ (পিংক ফ্লয়েডের ‘অ্যানাদার ব্রিক ইন দ্য ওয়াল’–এর অনুসরণে কি?) হোক কিংবা ‘কেষ্ট’।
শিলাদা, যাকে গ্রামারের ভাষায় ট্রেইন্ড সিঙ্গার বলে, সেটা বোধহয় নয়। প্রচণ্ড গরমের পর প্রথমবার বৃষ্টি ভিজে আনন্দে চিৎকার করে উঠেছিল যে গুহাবাসী আদিমমানুষ, সে কি ক্লাসিক্যাল মিউজিক জানত? জানত না। তা বলে কি তার চিৎকারটা গান নয়? শিলাদা ওই আদিমমানুষটা। Raw, primitive। কাঁচা মাংসের মতো কঠিনপাচ্য। গিলে নেওয়া সহজ। হজম করা কঠিন।
ভাগ্যিস শিলাদা গতানুগতিক নয়। এতদিন আমরা কী দেখেছি? দেখেছি, গানের শেষ শব্দ দিয়ে অন্ত্যমিল হয়। যেমন?
‘চোখে চোখে কথা বলো, মুখে কিছু বলো না
মন নিয়ে খেলা করো, এ কী ছলনা’
শিলাদা কী দেখাল? দেখাল...
‘ঢুলুঢুলু চোখ শালা
দেখি কত লোক নিয়ে
তাকিয়াতে ঠেস বলে
আহা বেশ বেশ বেশ’
লাইনের শেষ শব্দ শালার সঙ্গে পরের লাইনের নিয়ে–র মধ্যে কোনও মিল নেই। মিল কোথায়? না, চোখের সঙ্গে লোক। ঠেসের সঙ্গে বেশ। লাইনের শেষ শব্দের আগের শব্দে।
গান লেখার গ্রামারে এই নিয়ম নেই কোথাও। তবু শিলাদা লিখেছে। কোত্থাও বেমানান মনে হয়নি। এও এক মাস্তানি বই কি। বাংলা গানে আহাহাহা, হুম, ওহোহো— ইত্যাদি নানারকমের হামিং ছিল আগেই। শিলাদা কোথা থেকে নিয়ে এসে ঢুকিয়ে দিল আফ্রিকান আদিবাসীদের হামিং। আবার কখনও সাঁওতালিদের মতো ‘ওলোলোলোতামামামাতিমমামামায়মিতে’। ‘ভাবো তো সেদিন’ গানটা শুরু করেছে ইচ্ছাকৃতভাবে ‘একটা মার্শি ল্যান্ড’ কথাটা বারবার ফাম্বল করে, কন্টিনিউ করেছে আফ্রিকানদের মতো ‘হুরাহুরাহৌ’–এর হামিংয়ে, শেষ করেছে যুদ্ধক্ষেত্রের তলোয়ারের ঝনঝনানি, ঘোড়ার ক্ষুরের দাপাদাপি দিয়ে। ‘মধুছন্দাদি’ শুরু করেছে শাওয়ারে স্নানে জল আর শিসের শব্দে। ‘উড়তে চেয়েছিলাম’–এ ঢুকিয়েয়ে টাইপরাইটারের শব্দ।
তবে এক্সপেরিমেন্টের হদ্দমুদ্দ করেছে ‘ফিসফিস’–এ। আমার মতে, ওটাই শিলাদার সেরা অ্যালবাম। খুব এক্সেন্ট্রিক শিলাদা ফ্যান ছাড়া অ্যালবামটা ভাল লাগা মুশকিল। ঠিক ওল্ড মংকের মতো। যাদের ওল্ড মংক ভাল লাগে, তারা স্কচ ফেলে ওল্ড মংক খায়। আর যারা খায় না, তারা পছন্দই করে না।
শুনেছিলাম, শিলাদা প্রথম অ্যালবামের (ভূমিকা) ডেমো রেকর্ড হয়েছিল উপলদার (চন্দ্রবিন্দু) বাড়ির বাথরুমে। সম্ভবত রিভার্ব–এর গমগমে এফেক্টটা আনার জন্য। এমন আনঅর্থোডক্সভাবে যার শুরুটা হয়েছে, সে তো প্রথা ভাঙবেই। ফিসফিস–এর কথা আবারও বলতে হয়। ‘ফিসফিস’ আসলে এমন একজন ব্যক্তির রোজনামচা নিয়ে বানানো, যিনি মানসিক ভারসাম্যহীন। চলতি কথায় যাঁকে পাগল বলে ডাকা হয়। যিনি প্রকৃতির সঙ্গে যৌনতা করতে চান (বসুন্ধরা), যাঁর মাথায় নানারকম প্রশ্ন ঘোরে (ভাবা যাচ্ছে না), যিনি মাঝেমাঝেই ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখেন (ফিসফিসের টাইটেল ট্র্যাক, এই ট্র্যাকে দরজার ওপার থেকে ‘বিলু অ্যাই বিলু দরজা খুলছিস না কেন’– এই অংশটা শুনলে গায়ে কাঁটা দেয় এখনও), যিনি ফ্রি–তে কামড়ে দিতে চান (ফ্রি), যিনি রাতে ঘুমাতে পারেন না, শুধু লোডশেডিংয়ের মোমবাতির শিখা কাঁপা দেখেন। নিজের শরীরটাকে আগ্নেয়গিরি মনে করেন। যিনি মেঘলা দিনে বন্ধুকে (আসলে নিজের অন্তরাত্মাকে) কবিতা শোনাতে চান এবং বন্ধু (পড়ুন, ইনার মি) অফিসের অজুহাত দেখিয়ে কেটে দিলে হেসে বলে ওঠেন ‘হ্যাহ...পাগল’ (উড়তে চেয়েছিলাম)।
কে পাগল? যে অফিসের লেট হচ্ছে বলে মেঘলা দিনে ফোনে কবিতা শোনাতে চাওয়া বন্ধুর ফোন কেটে দেয়? নাকি যে মেঘলা দিনে কবিতা না শুনতে চেয়ে অফিসে যায়?
আমরা সেই বিখ্যাত সংলাপ শুনেছি, ‘কে পাগল, সেটা ডিপেন্ড করে আপনি পাগলাগারদে খাঁচার কোন দিকে দাঁড়িয়ে আছেন।’
আরও একটা অ্যালবামের কথা না বললে অন্যায় হবে। অ্যালবামটা অনেকেই শোনেনি— ‘একটি রাত শুইবার জন্য নয়, শুনিবার জন্য: কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য’। যে অ্যালবামে গানের ফাঁকে ফাঁকে কয়েকবন্ধুর রাতযাপনের অডিও রেকর্ড আছে।
এরকম কাজ বাংলাগানে আগে কখনও হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না। কারণ, শিলাজিৎ রক, ফোক, পপের মতো কোনও জঁরকে অনুসরণ করেন না। তিনি নিজেই একটি জঁর। যাকে শিলাদা ইয়ার্কি মেরে বলে, ‘শিলাসঙ্গীত’। একটা প্রায় ৬০ বছরের বুড়ো লোক স্টেজে যখন ওঠে, বিশ-বাইশের মেয়েরা অবধি পাগল হয়ে যায়, এমনই ক্রেজ!
শিলাদার নতুন গান শেষ বেরিয়েছিল অন্তত ১৪–১৫ বছর আগে। গানটার নাম ছিল ‘জানলা খোলো’। ইউটিউবে এখনও পাওয়া যায়। তারপর আর কোনও নিজের গান শিলাদা গেয়েছে বলে জানা নেই। গাইবে, গান বানাবে এরকম কোনও ইঙ্গিতও পাই না।
শিলাদা যেদিন অবসর নেবে, সেদিন এই জঁরটাও শেষ হয়ে যাবে। সম্ভবত শিলাদাই আমার দেখা একমাত্র বাংলা গায়ক, যে ফর্মে থাকতে থাকতে গান বানানো থেকে রিটায়ার করে নিল। কিন্তু ওস্তাদের ধার এখনও কমেনি। এখনও বাংলার অন্যতম অনস্টেজ সেরা পারফরমার। কিন্তু যদি গান বানানো থেকে অবসরও নিয়ে থাকে, তাহলেও সেটা সোয়্যাগেই নিয়েছে। ‘সর্বনাশ’ অ্যালবামের টাইটেল ট্র্যাকটা (যা কি না অ্যালবামের শেষ গানও বটে) শিলাদা শেষ করেছিল ব্রেকের আওয়াজ দিয়ে।
তারপর শিলাদার একটা ভয়েস ছিল, ‘অনেকেই ভাববে, এই অ্যালবামটা কেন ব্রেক কষে শেষ করলাম। যারা ভাববে, তাদের সঙ্গে আমার দেখা হবে। যারা ভাববে না, তাদের আমি দেখে নেবো।’
ওস্তাদ দেখে কিন্তু নিচ্ছে। সজ্ঞানে। স্টেজে স্টেজে। লাইভে লাইভে। বাংলা নাম্বারপ্লেটের সাদা স্করপিওটায় (জানি না, এখনও ওই গাড়িটাই ইউজ করে কি না) ঘুরতে ঘুরতে।
উরিবাবার একটা শো–তে শিলাদাকে বলতে দেখলাম, ‘কোনও শালা মরার আগে মরবে না। যদি পারি, শিস দিতে দিতে মরব। আমি মরে গেলে আমাকে কবর দিতে বলব। আর ছেলেকে বলব, এখানে লিখে দিস, মালটা বেঁচে ছিল। ফুর্তি করে বেঁচেছিল।’
তুমি বেঁচে থাকো গুরু। ক্ল্যাসিক গ্রামারের নিয়ম মেনে নয়, তোমার মতো নিপাতনে সিদ্ধ হয়েই বেঁচে থাকো। হ্যাপি বার্থ ডে!
সিটি! উড়োচুমু! হাততালি! জয়গুরু!