You are currently viewing সজারুর কাঁটা থেকে গ্রামাফোন পিন, ব্যোমকেশের গল্পে অদ্ভুত যত খুনের অস্ত্র…

সজারুর কাঁটা থেকে গ্রামাফোন পিন, ব্যোমকেশের গল্পে অদ্ভুত যত খুনের অস্ত্র…

Share this post

বেঁচে থাকলে বসের আজ বয়স হতো ১২৬।
ইস্টবেঙ্গল না মোহনবাগান, উত্তম না সৌমিত্র, ইলিশ না চিংড়ি— এরকম নানা বিতর্কের মতোই ফেলুদা না ব্যোমকেশ, এনিয়েও কম টেবিল চাপড়াচাপড়ি হয়নি। আমি নিজে ফেলুদা এবং ব্যোমকেশ দু’‌টিরই ভক্ত। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেও বুঝতে পেরেছি, আমি ক্রমেই ঝুঁকে পড়ছি ব্যোমকেশের দিকে।
ফেলুদা পিকচার পারফেক্ট। গড়পড়তা বাঙালি যা চট করে হতে পারবে না, ফেলুদা তাই। ছ’‌ফিটের ওপরে হাইট। ঝকঝকে হ্যান্ডসাম, অব্যর্থ বন্দুকের নিশানা, চরম আইকিউ, তুখোড় স্মৃতিশক্তি। তার চলনে–বলনে, হাঁটাচলায়, কথা বলায় হিরের ঔজ্বল্য ঠিকরে বেরিয়ে আসে। পনেরো জনের মধ্যেও ফেলুদা সামনে এলে ব্যাকগ্রাউন্ডে কোথাও ‘‌আমাকে দেখুন’‌–এর রিংটোন বাজতে থাকে। ব্যোমকেশ ঠিক অমন নন। প্রথম গল্পে তার বর্ণনায় শরদিন্দু জানাচ্ছেন, বয়স তেইশ–চব্বিশ। গায়ের রং ময়লা। শিক্ষিত ভদ্রলোকের ছাপ তার চেহারায় আছে। চোখেমুখে বুদ্ধির উপস্থিতি। বেশভূষার যত্ন নেই, চুল অবিন্যস্ত। পায়ের জুতো জোড়াও ময়লা।
দৃশ্যত ফারাকটা কল্পনা করুন। সৌমিত্র আর অনির্বাণের মধ্যে যা তফাৎ, তাই।
তবে ব্যোমকেশের গল্পে আমাকে যা সবচেয়ে বেশি ‘‌থ্রিল’‌ করেছে, তা হল খুনের অস্ত্র এবং চোরাই মাল লুকানোর জায়গা। খুনে কখনও গ্রামাফোনের পিন, কখনও সজারুর কাঁটা, কখনও বিষবাষ্পের দেশলাই, কখনও সেলাইয়ের সুচ, কখনও স্রেফ রদ্দা যাতে কি না গলার তরুণাস্থি ভেঙে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়, কখনও আবার ফাউন্টেন পেন ব্যবহার হচ্ছে। আবার ব্যোমকেশের ভিলেন কখনও সীমান্তহীরা লুকোন প্লাস্টার অফ প্যারিসের নটরাজ মূর্তির মধ্যে। কখনও রক্তমুখী নীলা লুকানো হয় গলার মধ্যে বানানো পকেটে। কখনও আবার মণিমণ্ডনের বহুমূল্য হার লুকানো হয় পোস্টবক্সের মধ্যে। এ সব জিনিসই আমাদের চারপাশে ছড়ানো ছিটানো। কিন্তু আমনজরে কখনও মনেই হয়নি, এগুলোও রহস্যের উপাদান হয়ে উঠতে পারে।
এমনই নানা ‘‌হতে পারে, কিন্তু হয়নি’‌–র কারণে ধুতি–পাঞ্জাবি পরা সাদাসিধা যুবকটি ক্রমেই ঝাঁ চকচকে ফেলুদাকে সাইডে রেখে আমার মনের কাছাকাছি চলে আসতে লাগল।
শরদিন্দুবাবু রসিক লোক ছিলেন। চরিত্রের নামকরণে কী অদ্ভুত মুন্সিয়ানা ছিল ভদ্রলোকের!‌ ‘‌বেণীসংহার’‌ ভাবুন। আইবুড়ো যুবক নিখিলকে গোপনে প্রেমপত্র লেখে কোনও তরুণী। সে যে আপপাশেই আছে, তা বুঝতে পারে নিখিল। কিন্তু তাকে খুঁজে পায় না। পরে দেখা যায় সেই চিঠির লেখিকা ঝিল্লি‌‌! যে কি না, যৌথ পরিবারে তারই সঙ্গে এক বাড়িতে থাকে।
ঝিল্লি অর্থাৎ ঝিঁঝিঁপোকা। যার ডাক শোনা যায়, উপস্থিতি টের পাওয়া যায়, কিন্তু দেখা যায় না চট করে। কী দুর্দান্ত প্রতীকী।
একইরকম মুন্সিয়ানা র‌য়েছে ‘‌রক্তের দাগ’‌–এর মূলচরিত্র সত্যকামের নাম নির্বাচনেও।‌ গল্পের সত্যকামের পিতৃপরিচয় নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল। ছান্দোগ্য উপনিষদেও আমরা সত্যকাম চরিত্রটির গল্প পড়েছি। উপনিষদের সত্যকাম যখন তার মা জাবালাকে তার জন্মদাতার নাম জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তখন জাবালাও পিতার নাম বলতে পারেননি।
তবে নামকরণের সবচেয়ে লাগসই কাজটি শরদিন্দু করেছেন সত্যবতীর সঙ্গে ব্যোমকেশের প্রেম এবং বিয়ে দিইয়ে। ব্যোমকেশ গোয়েন্দা নন। তিনি সত্যাণ্বেষী। সত্যান্বেষণই যাঁর নেশা ও পেশা, তাঁর স্ত্রীর পক্ষে সত্যবতীর চেয়ে ‘‌খাপে খাপ’‌ নাম আর কী হতে পারে।
বাংলার প্রতিষ্ঠিত গোয়েন্দাদের মধ্যে ব্যোমকেশ ছাড়া কেউ প্রেম ও বিয়ে করেছেন বলে জানা নেই। করে থাকলেও কেউ সন্তানাদি লালন–পালন করেছেন এমন ঘটনাও বেনজির। ঠিক যেমন বেনজির তাঁরই মূল প্রতিদ্বন্দ্বী যিনি, সেই ফেলুদার স্রষ্টা খোদ সত্যজিৎ রায়ের ব্যোমকেশকে নিয়ে ফিল্ম বানানো।
এটাই বোধহয় ব্যোমকেশ সুপ্রিমেসি, এটাই শরদিন্দু সুপ্রিমেসি।
শুভ জন্মদিন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।

Share this post

Leave a Reply