সৌরভ পারেননি, রোহিত পারলেন।
আবার সেভাবে দেখতে গেলে, সৌরভই পারলেন। বরং বলা ভালো, রোহিতের হাত ধরে পারিয়ে নিলেন। ঠিক সেই একই কারণে, হেরে গিয়েও জিতে গেলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।
২০০০ সাল এবং ২০০২–এর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। একবার ফাইনালে উঠেও নিউ জিল্যান্ডের কাছে হার। সেঞ্চুরি করেও জেতাতে পারেননি সৌরভ। অন্যবার বৃষ্টিতে ধুয়েমুখে সাফ ম্যাচ। ধারে–ভারে পিছিয়ে থাকা শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যুগ্ম বিজয়ী হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল বেহালার মহারাজকে।
এবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ২০২৫। ভারত চ্যাম্পিয়ন। এবং ফাইনালে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ রোহিত গুরুনাথ শর্মাই।
৮৩ বলে ৭৬ রান। ৭টা বাউন্ডারি, ৩টে ওভার বাউন্ডারি। স্ট্রাইক রেট? ৯১.৫৬!
রোহিত তো চওড়া হাস হাসছেনই, নেপথ্যে হাসি ফুটছে সৌরভের মুখেও। শুনতে অবাক লাগলেও রোহিতদের এই জয়ে তাঁর অবদানও তো কম নয়।
কেন? জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে তিন–চার বছর।
২০২১–এ অধিনায়কের পদ থেকে বিরাট কোহলিকে সরানোর পরে মেন ইন ব্লু–র অন্দরমহল রীতিমতো গনগনে আগুনের তাপে ফুটছে। মুখে বিদ্রোহের বুলি কেউ উচ্চারণ করেননি ঠিকই, তবে দল রীতিমতো দ্বিধাবিভক্ত। ঠিক এই সময়ে প্রস্তাব গেছিল রোহিতের কাছে। বোর্ডের বার্তা, এসো ক্যাপ্টেন হও। দলের সিনিয়র প্লেয়ার। আইপিএলে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সকে বারবার চ্যাম্পিয়ন করেছেন। রোহিত তখন বোর্ডের কাছে অধিনায়ক হওয়ার আদর্শ ক্যান্ডিডেট, পাত্রীপক্ষের কাছে সরকারি চাকুরে ব্যাচেলরের মতোই অটোমেটিক চয়েস। কিন্তু ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ব মানে মুকুট তো বটে, তবে তাতে কাঁটাও বিস্তর। রোহিত নাকি সৌরভকে বলেছিলেন, ‘দাদি, আমি ক্যাপ্টেন হতে চাই না।’ অথচ দলের একাংশ এবং টিম ম্যানেজমেন্ট তাঁকেই নেতার আসনে চাইছে। সেই সময় দাঁড়িয়ে রোহিতের এই প্রত্যাখানের দৃশ্য ভাবলে একটাই রঁদেভু হয়— যেন সন্ন্যাসী রাজার উত্তমকুমার বলছেন, ‘তোমরা আমার নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছো? কিন্তু বিশ্বাস করো, রাজা হতে আমি আর চাই না।’
সৌরভ আবার রাজ সিং দুঙ্গারপুর মতো নরমপন্থী নন, যে কোনও এক বিষণ্ন দুপুরে স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে আজহারউদ্দিনকে আলতো প্রস্তাব ছুড়ে দিয়ে বলবেন, ‘মিয়াঁ, ক্যাপ্টেন বনোগে?’। তিনি দুঁদে ক্রিকেট কূটনীতিক। যা চান, তা নিয়ে ছাড়েন। উত্তরে সৌরভ রোহিতকে বলেছিলেন, ‘রাজি হলে ভাল। নইলে আমিই তোমার নাম ক্যাপ্টেন হিসেবে ঘোষণা করে দেবো।’ বার্তাটা খুব স্পষ্ট। এরপরেও যদি রোহিত ক্যাপ্টেন্সি নিয়ে ব্যাকফুটে যান, তাহলে লোকে তাঁকে ভিতু বলবে। খানিক উপরোধের ঢেঁকি গেলার মতো করেই নাকি রাজি হয়েছিলেন ক্যাপ্টেন হতে।
বিশ্বকাপ ২০২৩ থেকে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ২০২৫ অধিনায়ক হিসেবে রোহিত কী করেছেন, তা নিয়ে কথা না বাড়ালেও চলবে। ওডিআই বিশ্বকাপের ফাইনালে হারলেও জনগণমনের অধিনায়ক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন তিনি। এই বোধহয় প্রথম বিশ্বকাপ, যেখানে ফাইনালে হারার পরেও একটিও কটূকথা শোনা যায়নি ক্রিকেটারদের উদ্দেশে। অথচ সাধারণভাবে এই ধরনের হারের পরে আমাদের দেশে কী হয়, তা আমরা সকলেই জানি। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো। ওয়ান ডে বিশ্বকাপকে অতীত ইতিহাস বলে ঝেড়ে ফেলে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। তাও একা নয়, সদলবলে।
অথচ দেশের মধ্যেই ফিটনেস নিয়ে কম খোঁচা হজম করতে হয়নি রোহিতকে। ফিটনেস! যে ইস্যুতে বারবার বিদ্ধ হয়েছেন রোহিত। এই সেদিনও কপিলদেবের মতো কিংবদন্তি ফালাফালা করেছেন রোহিতকে তাঁর ফিটনেস ইস্যুতে প্রশ্ন তুলে। শর্মাজি কা বেটার ওজন ৭২ কিলো। পাঁচ ফিটে ন’ইঞ্চি উচ্চতার নিরিখে ওজনটা ওভারওয়েট নয় ঠিকই। তবে অ্যাথলিটসুলভ বলা চলে না মোটেও। তাঁরই সতীর্থ বিরাট কোহলির গ্যাডিয়েটরদের মতো নির্মেদ চেহারা এবং ফিটনেসের ধারেকাছেও যান না রোহিত। বরং জার্সি ছাপিয়ে তাঁর নাদুসনুদুস ভুঁড়ি প্রায়ই উঁকি মারে। ভুঁড়িওয়ালা অর্জুন রণতুঙ্গাদের বাইশ গজে দেখার দিন যে শেষ, তা বোধহয় রোহিতকে মনে করিয়ে দেননি কেউ। দেখে মনেই হবে না রোহিত শর্মা কোনও আন্তর্জাতিক দলের সদস্য। বরং কাঁধে একটা চামড়ার সাইডব্যাগ ব্যাগ চাপিয়ে দিলে দিব্যি তাঁকে মধ্যত্রিশের পাশের বাড়ির যুবক বলে চালিয়ে দেওয়া যায়, যিনি দশটা–পাঁচটা অফিসের জন্য বনগাঁ লোকালে চলে যাতায়াত করেন। ইভনিং স্ন্যাক্সে তেলজবজবে এগরোল আর উইকএন্ডে দু’পাত্তর হুইস্কিও হয়তো সাবড়ে দেন।
তবে কি না শেষ কথা কাজ বলে। যে দক্ষতায় রোহিত পুল মারছেন, একের পর এক শর্ট বল তুশ্চু করে গ্যালারিতে উড়িয়ে দিচ্ছেন, যে গতিতে পুল মারার সময় ব্যাটের সঙ্গে তাঁর কোমর হাফসার্কেল হয়ে ঘুরছে— দেখে বেলিডান্সারদের কোমরের নমনীয়তা মনে পড়ে যেতে বাধ্য। ওই কোমরের ঘোরাতেই ঢাকা পড়ে যাচ্ছে রোহিতের পাওভাজি প্রীতি, উড়ে যাচ্ছে সৌগত রায় কিংবা কপিলদেবের সমালোচনা। হটস্টারের গ্রাফিক্স দেখাল, নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে রোহিতের একটা ছক্কার পরে ওয়াংখেড়ের গ্যালারিতে দর্শকদের যে শব্দব্রহ্ম উঠল, তা ১১৫ ডেসিবেলের। সেই চিৎকারেই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে রোহিতের ভুঁড়ি নিয়ে ওঠা যাবতীয় গুঞ্জন।
এই প্লেয়ার নাকি আনফিট? ফিটনেসের প্রসঙ্গ আসে তখন, যখন নাদুসনুদুস ভুঁড়ি অথবা থলথলে চর্বি কাপ তোলার পথে অন্তরায় হয়ে ওঠে। আনফিট হয়েও যদি দলকে তিনতিনটে আইসিসি টুর্নামেন্টের ফাইনালে তোলা যায়, তাহলে অমন ফিটনেস ধুয়ে কি জল খাবো?
সব মিলিয়ে শর্মা জি কা বেটা হিট আছেন। শেষ এই পরিমাণ ভালবাসা ভারতীয় ক্রিকেটে কোন অধিনায়ক পেয়েছিলেন? উত্তর মহেন্দ্র সিং ধোনি। কিন্তু ধোনি অনেক দূরতর গ্রহ। প্রায় কোনও সাংবাদিকের কাছে তাঁর ফোন নাম্বার নেই। সাংবাদিক তো দূর, দলের অনেক সতীর্থও তাঁর মোবাইল নাম্বার জানেন না। কখনও কাউকে এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার দেননি। ধোনি যেন ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে সেই জ্যোতিষ্ক, যাঁকে টেলিস্কোপে দেখা তো যায়, কিন্তু সেখানে রকেট পাঠানোর কথা ভাবাও যায় না। তুলনায় রোহিত অনেকটাই পাশের বাড়ির ছেলে। যিনি জাতীয় দলে খেলেন বটে কিন্তু অফিস ছুটি থাকলে সন্ধেবেলা ক্লাবের ক্যারামবোর্ডের সামনে তাঁকে দেখাও যায়। রোহিতকে নিয়ে হালকা রসিকতা করা চলে। ফিনিশার ধোনি অবিশ্বাস্য সব ম্যাচ একা হাতে শেষ করেছেন। অন্যদিকে রোহিত ইনিংসের এমন সব ভিত গড়ে দিচ্ছেন, যার পরে না জেতাটাই অবিশ্বাস্য।
কোথাকার কে পীযূষ চাওলার জন্য ২০১১ বিশ্বকাপজয়ী দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল রোহিত শর্মাকে। চোখের সামনে দেখতে হয়েছিল বিরাট কোহলির উত্থান। দেখতে হল ধোনি সাম্রাজ্যের সূচনা ও স্বর্ণযুগ। এমনকী, অজিঙ্ক রাহানে (কোথায় তিনি, হারিয়েই তো গেলেন) ঝলমলে প্রবেশ। রোহিতের কেরিয়ার তখনও মীরাক্কেলে পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংলাপের মতো— ‘ভাল হয়েছে। তবে আরও ভাল করতে হবে।’ তবে শচীন তখনও বলে যেতেন, ‘আসল রোহিতকে এখনও কেউ দেখেনি।’ ভবিষ্যতের কথা ভেবে তো আর বর্তমানের দল গড়া সম্ভব নয়।
স্নানঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনেমনে তখন কী বলতেন রোহিত? সম্ভবত নিজেকে ফালাফালা করে প্রশ্নই করতেন, ‘কেন আমি পারছি না? আমার মধ্যে তো কোনও কিছুর খামতি নেই।’ শাহরুখ খানের ‘ওম শান্তি ওমে’ আমরা শিখেছি, সিনেমার মতোই আমাদের জীবনেও সবকিছু শেষ অবধি ঠিকই হয়ে যায় যদি আপনি আপনার কাজের প্রতি সৎ হন। যদি এক্সেলেন্সকে নিরন্তর ধাওয়া করে যাওয়ার জেদ আপনার থাকে, তাহলে বিমুখ ভাগ্যদেবতাও এক না এক সময়ে আপনার দিকে সুপ্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকাতে বাধ্য।
রোহিতের ক্ষেত্রে আর সেই ঠিক হওয়ার শুরুটা হয়েছিল ধোনির হাত ধরে। বিসিসিআই আর বীরেন্দ্র শেহওয়াগের মধ্যে তখন সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। এদিকে গৌতম গম্ভীরের ব্যাটে রানের খরা। অধিনায়ক ধোনির কপালে ভাঁজ। সামনেই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। কে ওপেন করবেন? আচমকাই ধোনির মনে হয়, রোহিতকে দিয়ে ওপেন করালে কেমন হয়?
নতুন বলের পেস আক্রমণ সামলাতে শিখর ধাওয়ানের সঙ্গে এবার মাঠে নামলেন রোহিত। বাকিটা ইতিহাস। যেন এতদিনের শান্তশিষ্ট অথচ প্রতিভাবান ব্রুস ব্যানার এবার পরিণত হলেন বিধ্বংসী আগ্রাসী হাল্ক–এ। ক্রিকেট বিশ্ব এই নতুন রোহিতের নাম দিল ‘হিটম্যান’। যিনি ঠান্ডামাথায় বোলারদের খুন করেন রানের পাহাড় দিয়ে পিষে থেঁতলে। ক্রিকেটবিশ্ব বুঝে গেল, ভারত আর শুধু বিরাট কোহলির কাঁধে ভর দিয়ে ব্যাট করবে না। বিরাটের সঙ্গে একই দক্ষতায় ব্লটিং পেপারের মতো চাপ শুষে নিতে এক নতুন তারার উদয় হয়েছে।
রোহিত গুরুনাথ শর্মা!
এতদিনে সত্যি হল শচীনের কথা। সেই যে, ‘আসল রোহিতকে দুনিয়া এখনও দেখেইনি।’ এইবার দেখল। জানল, ঠিক লোককে ঠিক জায়গায় ঠিক দায়িত্ব দিলে ফল আসতে বাধ্য। বেটার দ্যান অ্যাভারেজ থেকে লেজেন্ড হয়ে ওঠার সেই শুরু।
না। নয়। কারণ, ওই যে এক্সেলেন্সকে ধাওয়া করে যাওয়া। ওই যে বিশ্বাস, সাফল্য কোনও ঘটনা নয়, সাফল্য একটা নিরন্তর সফর। যা কখনও থামানো চলে না।
এই দর্শনে বিশ্বাস করলে একটা ওয়ান ডে বিশ্বকাপ ফাইনালের পরে একটা টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল আসতে বাধ্য। আবার ঠিক তার পরপরই একটা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালও আসতে বাধ্য।
বাড়াবাড়ি কিছু নয়। আপনি এটা ডিজার্ভ করেন। এটা আপনার প্রাপ্য!
আর জানবেন, জীবনে যদি আপনি সৎ থাকেন, আপনার প্রাপ্য পেতে দেরি হতে পারে, তবে প্রাপ্য মার যায় না। যেতে পারে না।
যদি যেত? তাহলে তো ক্রিকেট নামক রূপকথার থেকে আমাদের বিশ্বাসই উঠে যেত।
রূপকথার গল্পে দেখবেন, নায়ককে সাহায্য করতে কোনও না কোনও চরিত্র ঠিক এগিয়ে আসে। রোহিতের ক্ষেত্রে যেমন অধিনায়কত্ব নিতে নিমরাজি মুম্বইকরকে রাজি করিয়েছিলেন সৌরভ। সৌরভের জোরাজুরিতে কি এক রোহিতের পুনর্জন্ম হল? অবশ্যই হল। কেরিয়ারের শুরুতে রোহিতকে বিরাটের চেয়ে বেশি প্রতিভাবান ক্রিকেটার বলেই ভাবা হতো। রোহিতকে নিয়ে হাল্কা গুঞ্জনও শুরু হয়েছিল, শচীনের ধারেকাছে যদি কেউ যেতে পারেন, তাহলে হয়তো এই মুম্বইকরই। সেই গুঞ্জন স্টেডিয়ামের দর্শকদের সমর্থনের গর্জন হয়ে আছড়ে পড়েনি। বরং হাওয়ার স্রোত মুম্বই থেকে ভেসে ঘুরে গেছে রাজধানীর দিকে। দিল্লির বিরাট কোহলিকে সমর্থন জানাতে। আর রোহিত? থেকে গেছেন সেই তারকা হিসেবে, যাঁর মধ্যে সুপারনোভা হয়ে জ্বলে ওঠার প্রতিভা তো ছিল, কিন্তু ধারাবাহিকতা রইল না।
ভাগ্যিস এই রোহিতকেই ধরেবেঁধে কুইনাইন গেলানোর মতো তেতো ওষুধ খাইয়েছিলেন সৌরভ। তার ফল কী হল? অবশ্যই ভাল। ব্যাটসম্যান হিসেবেও, ক্যাপ্টেন হিসেবেও। ব্যাটসম্যান হিসেবেও কোনও একটি বিশ্বকাপে কোনও ভারতীয় অধিনায়কের সর্বোচ্চ মোট রান (২০০৩ বিশ্বকাপে সৌরভের ৪৬৫) পিছনে ফেলে ৫০০–এর বেশি রান করে ফেলেছেন। অধিনায়ক হিসেবেও কোনও বিশ্বকাপে কোনও ভারতীয় অধিনায়কের পরপর একটানা সবচেয়ে বেশি ম্যাচ জেতার রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডকে হারানোর পরে।
উত্তরপুরুষ রোহিতের হাতে ব্যাটসম্যান হিসেবে, অধিনায়ক হিসেবে হেরে গেলেও সৌরভ অখুশি হবেন না। কারণ, তিনি জানেন, ধরেবেঁধে রোহিতকে অধিনায়ক বানানোর পিছনের মাস্টারস্ট্রোকটা তো তাঁরই। তবে রোহিত যে কাজটা করছেন, সেটা বোধহয় এর আগে কোনও ভারতীয় অধিনায়ক করতে পারেননি। সবচেয়ে বড় কথা, ইনিংসের শুরুতে এমন সেল্ফলেস ক্রিকেট খেলেছেন, যা অন্য কোনও দলের অধিনায়ক ভাবতেও পারবেন না।
শুরুতেই দুমাদ্দুম মেরে বিপক্ষের বোলারদের ওপরে এমন রোডরোলার চাপিয়ে দাও, যাতে তারা মাথা তুলে দাঁড়াতেই না পারে। স্ট্রোকের দুরমুশ চালিয়ে মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানদের জন্য এমন সমতল জমি রেখে যাও, যাতে সেই জমিতে বড় রানের বাহারি ফুলের বাগান বানানো যায়। এই দুরমুশ চালানোর কাজটা দেওয়া হয় সাধারণত জুনিয়র প্লেয়ারদের ওপরে। কোনও দলেই কোনও সিনিয়র প্লেয়াররা এই রোলটা নিতে চান না। অধিনায়ক তো নেনই না।
এখানেই আমাদের ক্যাপ্টেন বাকি সবার চেয়ে আলাদা। আমাদের দেশে দল হারলে ক্যাপ্টেনও যদি কম রানে আউট হন, তাঁকে সপরিবারে ছিঁড়ে খাওয়া হয়। সেখানে সুইসাইড বোম্বারের এই রোলের জন্য রাজি হওয়া কম কথা নয়। তাও আবার যেখানে চাইলেই উল্টো দিকে শুভমান গিলের মতো তরুণ প্লেয়ার রয়েছেন, যাঁর হাতে স্ট্রোকের ফুলঝুরি। চাইলেই এই অপ্রিয় কাজটা গিলকে দেওয়া যেত। কিন্তু না, কাজটা নি:শব্দে রোহিত করে যাচ্ছেন।
কিন্তু লিডিং ফ্রম দ্য ফ্রন্ট বলে একটা কথা হয়। ক্যাপ্টেন যদি সামনে থেকে লড়েন, ক্যাপ্টেনই যদি প্রথম এগিয়ে শত্রুর মুণ্ডু ছিঁড়ে নেয়, তাহলে বাকিদলও তেতে উঠতে বাধ্য। এতে অনেক সময়েই ক্যাপ্টেনের শরীর থেকেই প্রথম রক্তপাতটাও ঘটে। যেমন সেমিফাইনালে হল। নিশ্চিত হাফ সেঞ্চুরি মাঠে ফেলে এলেন রোহিত। এই যে প্রতি ম্যাচে শুরুতে ব্যাট করলে বলে বলে ৩০০+ রান উঠছে, এর একটা বড় কৃতিত্ব রোহিতকে দিতেই হবে। স্ট্রোকের ফুলঝুরিতে এমন সুফলা সার তিনি বাইশ গজে ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছেন, যে তারপরে বিরাট–গিল–শ্রেয়স–রাহুলদের ব্যাটে সতর্ক লাঙল চালালেই তিনশোর বেশি রানের ফসল উঠছে। ঠিক এই কারণেই চারটে হাফসেঞ্চুরি, দু’বার আশির ঘরে ঢুকেও শতক মাঠে ফেলে আসা কিচ্ছু তাঁর মনে দাগ কাটছে না। আগে দেশ, আগে দল, পরে ব্যক্তি। তা তিনি যতই ক্যাপ্টেন হন না কেন।
মার্কিন নৌসেনায় একটা চালু বুলি আছে... ‘আয় আয় ক্যাপ্টেন’ (aye aye captain)। যার অর্থ হল, হে আমার অধিনায়ক, যুদ্ধের সময় তুমি হুকুম দেবে, আমি তাই পালন করব। নেতার প্রতি এই আনুগত্যের শপথ কোনও যোদ্ধা কখন নিতে পারেন, যখন তিনি বুঝতে পারেন, দলের প্রয়োজনে নেতা নিজের পিঠ বাঁচানোর জন্য অন্য কাউকে ঝুঁকি নিতে বলছেন না। নিজে সবার আগে কোমর থেকে তলোয়ার বের করে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন, তারপরে বাকিদের বলছেন, ‘কই হে এসো, যোগ দাও।’ ঠিক সেই কারণেই রোহিতের দলে কোনও অন্তর্কলহ নেই। যাঁকে যেখানে যে কাজে মোতায়েন হতে বলা হচ্ছে, তিনি সেটাই করছেন।
তবে এ সবের পিছনে হাসিমুখে রাজার সিংহাসনে রাজমুকুট হাতে নিয়ে বসে আছেন আমার রাজা, আমার নেতা, আপামর ভারতবাসীর নেতা রোহিত গুরুনাথ শর্মা। যাঁর রাজদরবারে একজোড়া আইসিসি ট্রফি আছে কিন্তু কোনও অন্তর্কলহ নেই।
এমন ক্যাপ্টেনের জন্য জান হাজির থাকবে না তো কার জন্য থাকবে?
রোহিত গুরুনাথ শর্মা... আয় আয় ক্যাপ্টেন, উই লাভ ইউ।