১৪ বছর বয়সে কোনও কিশোর কী করে? মূলত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে। বৈভব সূর্যবংশী ব্যাট হাতে যা শুরু করেছে, তা দেখে আমাদের মতো আধবুড়োদের মনে হতে বাধ্য, বাপ রে! চোখের সামনে এ কী দেখছি? স্বপ্ন নয় তো?
একই সঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে আর একটা কথা। আইপিএল শুরুর আগে বিজ্ঞাপনটার কথা মনে আছে তো? চোখে পড়েছিল? চেন্নাই সুপার কিংসের মহেন্দ্র সিং ধোনি রাজস্থান রয়্যালসের সঞ্জু স্যামসনকে হালকা শ্লেষমাখা প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন, ‘কী রে, তোদের দলে নাকি একটা ১৩ বছরের বাচ্চাকে নেওয়া হয়েছে? ওর জন্মের আগে তো আমার আইপিএল জেতা হয়ে গিয়েছিল।’
ভাবখানা এমন, ১৩ বছরের বাচ্চা নিয়ে দল গড়েছিস! সে আর কী খেলবে? তোদের দলই বা কতদূরে যাবে?
৪৩ বছরের ধোনি কি সোমবাসরীয় আইপিএলে সেই ১৩ বছরের (এই মুহূর্তে ১৪ অবশ্য) ‘বাচ্চার’ তাণ্ডবলীলা দেখলেন? নিশ্চয়ই দেখেছেন। মনে মনে কি আর ধোনি অন্তত একবার ঢোঁক গিলে কবুল করেননি, এই ‘বাচ্চার’ জন্মের আগে তাঁর আইপিএল জেতা হয়ে গেলেও, আইপিএল দেখার, আইপিএল–কে চিনে নেওয়ার বিস্তর বাকি ছিল তাঁর।
অবশ্যই ছিল! কারণ তখনও তো আইপিএলে বৈভব সূর্যবংশী নামক ক্রিকেটীয় ওয়ান্ডারের পদার্পণ ঘটেনি। কারণ এমন স্বপ্নের ইনিংস হয় তো গোটা দশকে একবারই খেলা হয়। মঙ্গলবার সকালে বৈভব যখন ঘুম থেকে উঠবেন, হোটেলের স্নানঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একবার অন্তত চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করবেনই, ‘কাল যা হলো, তা স্বপ্ন নয় তো? সত্যিই ঘটেছে তো?’
না সোমবার গুজরাট টাইটান্সের বিরুদ্ধে ৩৫ বলে ১০০ রানে পৌঁছনো স্বপ্ন নয়। শেষ পর্যন্ত ৩৮ বলে ১০১। ১১টা ছক্কা, ৭টা চার। আইপিএলের ইতিহাসে দ্বিতীয় দ্রুততম সেঞ্চুরি। এর আগে শুধু কুড়ি ওভারের ক্রিকেটের কিংবদন্তি ক্রিস গেইল (৩০ বলে সেঞ্চুরি)। বৈভরের সেঞ্চুরির ৯৪টা রানই এসেছে ছক্কা আর চারে। স্ট্রাইক রেট ২৬৫!
কয়েকদিন আগেই হাফসেঞ্চুরি হাতছাড়া করে কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়াটা যেমন রূঢ় বাস্তব। তেমনই সোমবার সেঞ্চুরির পরে সোয়াই মান সিং স্টেডিয়ামে হাসিমুখে ডাগআউটে বসে থাকা রাহুল দ্রাবিড়ের দিকে হাসিমাখা চাউনি ছুড়ে দেওয়াটাও স্বপ্নপূরণের মধুর বাস্তব।
১৪ বছর ৩২ দিন বয়সে বৈভব যখন ব্যাট হাতে গুজরাটকে দুরমুশ করছে, তখন গোটা ক্রিকেটবিশ্ব দেখল, তার চওড়া ব্যাটের সামনে কীভাবে ধসে পড়ছে মহম্মদ সিরাজ থেকে অভিজ্ঞ ইশান্ত শর্মাদের পেস আক্রমণ। কীভাবে এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম সেরা স্পিনার রশিদ খানকে নিয়ে স্রেফ ছেলেখেলা করে গেলো সে।
কী করে এই বয়সে এমন দানবীয় দক্ষতার মালিক হলো বৈভব? জানতে গেলে ফিরে যেতে হবে আরও কয়েকবছর আগে। বিহারের সমস্তিপুরে বৈভবের বাবা একজন মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী। একটা দোকান ছিল। আর ছিল কিছু জমিজমা। চার বছর বয়সে বাবার কাছে ক্রিকেটের হাতেখড়ি। বৈভবের বাবা সঞ্জীব দেখেছিলেন সমস্তিপুরের তাজপুর এলাকায় যথেষ্ট উন্নতমানের ক্রিকেট অ্যাকাডেমি নেই। বয়স যখন সাত, জমি বেচে ছেলে বৈভবকে তিনি নিয়ে গেলেন পাটনায় কোচ সৌরভ শুক্লর কাছে। তাজপুরের বাড়ি থেকে পাটনার সেই অ্যাকাডেমির দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার। মানে প্রায় শিয়ালদহ থেকে কৃষ্ণনগর যতটা দূরত্ব, ততটা। ভোর চারটেয় মায়ের বানানো টিফিন ব্যাগে পুরে বাবার হাত ধরে পাটনার উদ্দেশে রওনা দিত সে। পৌঁছত সকাল সাতটায়।
রোজ নয়, বৈভবকে তার বাবা নিয়ে যেতে শুরু করলেন একদিন অন্তর একদিন। ওই একদিন নেটে না যাওয়ার ক্ষিদে বৈভব মেটাতো পাঁচগুণ পরিশ্রম করে। অন্য বাচ্চারা গড়পড়তা নেটে ১০০ বল খেলত। আর বৈভব খেলত ৫০০ বল। মানে ব্যাট করত প্রায় ৮৪ ওভার। মানে চারটি টি–টোয়েন্টি ম্যাচের দ্বিগুণেরও বেশি! শুধু তাই নয়, সমবয়সি বোলারদের নয়, বৈভব নেটে নামত তারচেয়ে বয়সে ঢের বড় বোলারদের সামনে। তার এক–একটা শটের সপাটে নেটের জালে আছড়ে পড়া দেখতে দেখতে কোচ সৌরভ বুঝতে পারেন, এ ছেলে বড় সামান্য নয়।
বৈভবের প্লেসমেন্ট, শটের পাওয়ারের কথা ক্রমেই ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আইপিএলের মরসুম আসতেই বৈভবের কথা সব দলেরই কানে যায়। প্রায় সব দলই বৈভবের ব্যাটিংয়ের ভিডিও চেয়েছিল। ট্রায়ালে ডাকে দিল্লি ডেয়ারডেভিলস আর রাজস্থান রয়্যালস।
১৯ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে রাজস্থান রয়্যালসের ট্রায়ালে বৈভবকে দেওয়া হয়, বিশেষ ‘সিচুয়েশন’— এক ওভারে ১৯ রান করতে হবে।
ওভারের প্রথম তিনটে বলেই তিনটে ছক্কা হাঁকিয়ে 18 রান তুলে দেয় বৈভব। তারপর নাকি খানিক চুপচাপ নির্বাচকদের দিকে তাকিয়ে ছিল সে। যার একটাই অর্থ হয়। আর তো তিন বলে এক। বাকিটা খেলতে হবে? ১৩ বছরের সেই বৈভব সূর্যবংশী সাধারণ ক্রিকেট অ্যাকাডেমি থেকে রাজস্থান রয়্যালসের নেটে এবং সেখান থেকে ছ’দিনের মধ্যে ঢুকে পড়ল আইপিএলে।
নিলামের সময়েও বৈভবকে নিয়ে নাটক কম হয়নি। তাকে নিয়ে লড়াইটা হয়েছিল মূলত রাজস্থান এবং দিল্লি ক্যাপিটালসের মধ্যে। ৩০ লক্ষের বেস প্রাইস থেকে তার দাম পৌঁছে গেছিল ১ কোটি ১০ লক্ষ টাকায়। শেষ পর্যন্ত রাজস্থানই কিনে নেয় ১৩ বছর ২৪৩ দিনের বৈভবকে। কারণ, বৈভবকে দলে নেওয়ার ব্যাপারে নাছোড় মনোভাব ছিল রাজস্থানের মেন্টর রাহুল দ্রাবিড়ের। কোন দ্রাবিড়? না, তরুণ প্রতিভাকে চিনে নেওয়ায় যাঁর দক্ষতা প্রশ্নাতীত। যাঁর হাত ধরে তৈরি হয়েছেন যশস্বী জয়সওয়াল, শুভমন গিলের মতো ক্রিকেটার।
বৈভবের রূপকথার মতো ইনিংসের পরে অবধারিতভাবেই তার নামের সঙ্গে আর একজনের নাম জড়িয়ে ফিসফাস শুরু হয়ে গিয়েছে। ১৯৮৯ সালে ১৬ বছর ২০৫ দিন বয়সে পাকিস্তানের করাচিতে বাউন্ডারি রোপ পেরিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রেখেছিলেন শচীন রমেশ তেন্ডুলকর। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শচীনের আগেই কি বৈভবের অভিষেক হয়ে যাবে? আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বৈভবই হবেন পরবর্তী শচীন? এই দূরত্বটুকু কিন্তু বড়ই পিচ্ছিল। পা পিছলে যেতে পারে অনেকেরই। আকাশছোঁয়া প্রতিভা নিয়ে আমরা পৃথ্বী শ’–কে হারিয়ে যেতে দেখেছি। আবার, পাহাড়প্রমাণ সম্ভাবনা নিয়েও দেখেছি বিনোদ কাম্বলির পতন। রাজস্থান রয়্যালস ইতিমধ্যেই বৈভবকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করেছে। দ্রাবিড় হয়তো চাইছেন না বৈভবের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটুক।
ঘটা উচিতও নয়। ভারতীয় ক্রিকেটের স্বর্ণযুগ চলছে। শুভমান গিল, অভিষেক শর্মা যশস্বী জয়সওয়ালদের সঙ্গে জাতীয় দলে ওপেন করার দৌড়ে বৈভবের মতো সম্ভাবনাময় তারকার নামও উঠে আসুক, এও আমরা চাই সমর্থক হিসেবে। কিন্তু বাকিপথ টুকু আর একটু সাবধানে। বৈভব যেন নিজেকে ঠিক রাখতে পারে, তার যেন মাথা ঘুরে না যায়, এটুকু ভয় কাজ তো করেই।
অবশ্য ঈশ্বরচন্দ্র তো সেই কবেই লিখে গেছেন, ‘স্নেহের স্বভাবই এই অনিষ্ট আশঙ্কা করে।’
