স্টুয়ার্ট ব্রড অবসর নিলেন।
ইংল্যান্ডের একজন পেসার অবসর নিলে আমাদের ধোনি–কোহলির দেশে কীই বা আর আসেযায়? বড়জোর আমরা এই খবর শোনার পরে স্মৃতি হাতড়ে একবার মনেমনে বলতে পারে, ‘অ, এই সেই ব্রড না, যে যুবরাজের হাতে ছ’টা ছক্কা খেয়েছিল!’ কিন্তু স্টুয়ার্ট ক্রিস্টোফার জন ব্রড মানে কি শুধুই যুবরাজের ব্যাটের নির্মম শাসনে কুঁকড়ে যাওয়া সোনালি চুলের এক ইংরেজ বোলার?
না, বরং তার চেয়ে অনেকটাই বেশি। বলা চলে, খাদের অতলে তলিয়ে গিয়েও ঘামঝরানো শ্রমে ধীরে ধীরে পর্বতশৃঙ্গে ফিরে আসা এক ক্রিকেটারের কাহিনী। যে কাহিনী না জানলে ক্ষতি আমাদেরই। কারণ, সেই ঘাম ঝরানোকে সম্মান না দিলে ক্রিকেটীয় স্পিরিটের অপমান হয়।
২০০৭–এর টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ব্যাট করছেন মহেন্দ্র সিং ধোনি এবং যুবরাজ সিং। গায়ে পড়ে এসে নাগাড়ে কুমন্তব্য করে গেলেন ইংল্যান্ডের অলরাউন্ডার অ্যান্ড্রু ফ্লিন্টফ। যুবরাজ কোনওদিনই ধোনির মতো শীতলমস্তিষ্কের ব্যাটার হিসেবে পরিচিত নন। তাঁর নীতি ব্যাট থাকতে মুখে কেন। ফ্লিন্টফের ঝাল গিয়ে গিয়ে পড়ল পরের ওভারে বল করতে আসা স্টুয়ার্ট ব্রডের ওপরে। পরপর ছ’টা বলে ছ’টা ছয় মেরে বসলেন ব্রডকে। ছ’বলে ছ’টা ছয়! একজন ২১ বছর বয়সি পেসারের মনোবল ও কেরিয়ার শেষ করে দেওয়ার জন্য ব্যাপারটা যথেষ্ট। তাছাড়া ইংল্যান্ডের সমর্থকদের যে সংগঠন অর্থাৎ সেই ‘বার্মি আর্মি’ সারা বিশ্বেই গুন্ডামির জন্য কুখ্যাত। পান থেকে চুন খসলে নিজের দলের ক্রিকেটারদেরও ধুনে দিতে ছাড়েন না তাঁরা। যে কোনও বোলারের কেরিয়ার ওখানেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। অন্য কেউ হলে লজ্জায়–অপমানে বোলিং বুটজোড়া বোধহয় পাকাপাকিভাবে আলমারিতে তুলেই রাখতেন। ওই ‘ধরণী দ্বিধা হও’ পরিস্থিতি থেকে পরিস্থিতি থেকে ১৬ বছর পরে ব্রডের কেরিয়ার যেভাবে শেষ হল, বোধহয় দক্ষিণী মসালা ফিল্মের কোনও স্ক্রিপ্টরাইটারও তাঁর নায়কের জন্য এরকম চিত্রনাট্য লিখতে পারতেন না।
অবসরের পরে ব্রডের নামের পাশে এখন কী কী কীর্তি?
১) ২০০৭ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ১৬৭টি টেস্ট ম্যাচ খেলে ৬০৪টি উইকেট। টেস্টে ৬০০–এর বেশি উইকেট নিয়ে। যে কৃতিত্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে দেখাতে পেরেছেন মাত্র পাঁচজন বোলার। এর আগে এই কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছেন মাত্র একজন পেসার! ৬০০+ উইকেট পাওয়া বোলারদের নামগুলোও একটু শুনে নেওয়া যাক। তাহলে হয়তো ব্রডের কীর্তির ওজনটা বোঝা যাবে। শেন ওয়ার্ন, অনিল কুম্বলে, মুথাইয়া মুরলীধরন এবং জেমস অ্যান্ডারসন!
২) ওয়ান ডে ক্রিকেটে ১২১টা ম্যাচ খেলে ১৭৮টা উইকেট।
৩) ৫৬টা টি–টোয়েন্টি খেলে ৬৫টা উইকেট।
৪) টেস্ট, ওয়ান ডে, টি–টোয়েন্টি— সব মিলিয়ে ৩৪৪টা আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে মোট ৮৪৭টা উইকেট। যার মধ্যে সেরা বোলিং ১৫ রানে ৮ উইকেট!
সাধে কী আর সেদিনের ঘাতক যুবরাজ সিং পর্যন্ত ব্রডের অবসরের খবরে টুইট করে বলেছেন, ‘ ব্রড, তুমি একজন সত্যিকারের লেজেন্ড!’
খাঁটি ক্রিকেটীয় স্পিরিট!
অথচ, ব্রডের ক্রিকেটার হওয়ার কথাই ছিল না। ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর ধ্যানজ্ঞান ছিল হকি। খেলতেন গোলকিপার পোজিশনে। তবে মূলত বাবার প্রভাবেই হকি ছেড়ে ক্রিকেটের দিকে ঝোঁকেন। বাবা ক্রিস ব্রড ইংল্যান্ডের প্রাক্তন ওপেনার এবং পরবর্তীকালে আইসিসি–র ম্যাচ রেফারি।
ব্রডের বয়স ৩৭। বর্তমান ক্রিকেট দুনিয়ায় পেসারদের পক্ষে একটু বেশিই বটে। তবে তাঁরই সতীর্থ আর এক লেজেন্ড জেমস অ্যান্ডারসন ৪১ বছর বয়সেও চুটিয়ে খেলে যাচ্ছেন। এবারে অ্যাসেজ শুরু হওয়ার আগে তাঁর অবসর ঘোষণার খবর উড়ে বেড়াচ্ছিল। সেখানে, সবাইকে চমকে ব্রড অবসর ঘোষণা করে দিলেন। সমর্থকরা বিদায় জানালেন চোখের জলে।
সবাই যখন অ্যান্ডারসনের বিদায়ের জন্য মনে মনে প্রস্তুত, তখনই আচমকাই অবসর ঘোষণা করে দিলেন ব্রড। অ্যাসেজের নাটকীয় ম্যাচের ততধিক নাটকীয় ক্লাইম্যাক্সে দৃশ্যেও ব্রড এলেন নায়কের মতোই। শেষ স্পেলে যখন ইংল্যান্ডের অধিনায়ক বেন স্টোকস ব্রডের হাতে বল তুলে দিচ্ছেন, ইংরেজ পেসারের মুখে তখন মুচকি হাসি। অ্যালেক্স ক্যারিকে অনেকবার বিট করলেন। একবার বল স্লিপ ফিল্ডারের ঠিক আগে ড্রপ পড়লো, কিন্তু শেষ হাসি ব্রডই হাসলেন। মাঠে ঢুকেছিলেন নায়কের মতো। অ্যাসেজের মতো হাড্ডাহাড্ডি শত্রুতার সিরিজে মাঠে যখন শেষবারের মতো পা রাখলেন, তখন চিরশত্রু অস্ট্রেলিয়া তাঁকে গার্ড অফ অনার দিচ্ছে। দেখে কে বলবে, এই সেই ব্রড, যাঁর কেরিয়ারই ডুবে যাচ্ছিল যুবরাজ সিংয়ের ছ’–ছ’টা ছক্কায়। আর কেরিয়ার যখন শেষ করলেন তখন সেই ছ’–ছ’টা ছক্কার চেয়ে ব্রডের নামের পাশে শতগুণে উজ্জ্বল ৬০০ উইকেট শিকারের অবিস্মরণীয় কীর্তি। তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ গ্লেন ম্যাকগ্রা থেকে মাইকেল ভন।
দুঃসময় জীবনের অঙ্গ। এক না একদিন আসবেই। কেউ তাতে ভেঙে পড়েন, কেউ বা অপমানকেই করে নেন ঘুরে দাঁড়ানোর পাঠক্রমের প্রথম চ্যাপ্টার। ব্রড দ্বিতীয় দলে পড়েন। তিনি বলেছেন, ‘আমি ওই ঘটনার (যুবরাজের হাতে ছ’টা ছক্কা) পর থেকে ট্রেনিং নিয়ে খুব সিরিয়াস হয়ে যাই। তার আগে আমার কোনও প্রি-বল রুটিন ছিল না। এমনকী আমার ফোকাসও ছিল না। ওই তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে যে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তখন আমি ভাল পারফর্মার ছিলাম না।’ এর পরেরটুকু আরও দরকারি।
‘আমি সেই অভিজ্ঞতার পরেই নিজেকে যোদ্ধা হিসেবে তৈরি করতে শুরু করেছিলাম। যদি আমার কেরিয়ারে এই ঘটনা না ঘটতো, জানি না কী হতো। তবে এটা আমাকে প্রভাবিত করেছিল। সত্যিই সেটা আমাকে অনেক কিছুতে সাহায্য করেছিল। আমার মনে হয়, ওই স্মৃতি আমাকে আরও ভাল ক্রিকেটার হতে অনুপ্রাণিত করেছে।’
ক্রিকেট এমনই। বাইশ গজ আর সবুজ ঘাসের গালিচায় যত রক্ত, যত ঘাম ঝরাবেন ব্রডের মতো লড়াকুরা, ততই ঝকমকিয়ে উঠবে স্কোরবোর্ডে নাম। শুধু মাঠটা ছেড়ে যাওয়া চলবে না। এই লড়াই ভীষণ রোম্যান্টিক, ভীষণ সিনেম্যাটিক।
সিনেমার কথা ওঠায় মনে পড়ে যাচ্ছে ‘ওম শান্তি ওম’–এ শাহরুখ খানের মুখের সংলাপ। ওম শান্তি ওমের ওমপ্রকাশ মাখিজা যে কথা ফিল্মে বলেছিলেন, সেটাই কার্যত ঘটল স্টুয়ার্ট ব্রডের জীবনে। এবার রাতে ঘরে ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ব্রড বলতেই পারেন ‘‘সিনেমার মতো আমাদের জীবনেও শেষপর্যন্ত সব ঠিক হয়ে যায়। যতক্ষণ না সব ঠিক হয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে এটা দি এন্ড নয়। পিকচার আভি বাকি হ্যায়।’
