গত বছরের একটা সন্ধের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। সেই সন্ধ্যায় অফিস থেকে সবে বেরতে যাচ্ছি, এক সহকর্মিণী এসে প্রায় দৌড়তে দৌড়তে এসে চোখের সামনে মোবাইলটা মেলে ধরলেন। যেখানে জ্বলজ্বল করছে ‘বিগ ব্রেকিং! শেন ওয়ার্ন ইজ নো মোর!’
পেশাগত নিয়ম বলে, আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট নয়, সটান ডেস্কে বসো। কপি লিখে ফেলো। ক্রীড়া সাংবাদিকতায় ব্যাকরণ বলে, এই ধরনের নক্ষত্র পতনের খবর লেখার একটা নির্দিষ্ট নিয়ম থেকে। যার মধ্যে অন্যতম হল, কিংবদন্তির প্রয়াণে কোন তারকা কী বলছেন। অর্থাৎ রিয়্যাকশন। বীরেন্দ্র শেওয়াগ থেকে শচীন তেন্ডুলকর, ব্রায়ান লারা — ক্রিকেটীয় গ্রহের এমন কোনও প্রান্ত নেই, যেখানে ওয়ার্নের এই আকস্মিক প্রয়াণে শোকের কালো চাদর বিছিয়ে দেওয়া হয়নি। সকলেই লিখছেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ স্পিনারের এই আকস্মিক প্রয়াণ তাঁদের কতটা চমকিত করে দিয়েছে। আমার এখনও মনে আছে সেরা প্রতিক্রিয়াটা দিয়েছিলেন চিত্রপরিচালক অমর্ত্য ভট্টাচার্য। ছোট্ট কিন্তু সটান প্রতিক্রিয়া, ‘অ্যাজ লং অ্যাজ দ্য বল স্পিনস, শেন উইল বি অলাইভ।’ যার কাছাকাছি ভাবানুবাদ হতে পারে, ‘যতদিন বল ঘুরবে, শেন বেঁচে থাকবেন।’
জন্ন ১৯৬৯ সালে আজকের দিনে। বেঁেচ থাকলে ৫৪ বছরে পা রাখতেন। তিনি চলে যাওয়ার পরে একের পর এক মরণোত্তর সম্মানে ভরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁকে।
তুলনাটা মূলত হতো শেন ওয়ার্ন আর মুথাইয়া মুরলীধরনের মধ্যে। কেউ কেউ মনে করেন, অস্ট্রেলিয়ার মতো পেস বোলিং সহায়ক উইকেটের দেশে না জন্মে শেনের জন্ম যদি ভারত, বাংলাদেশ , শ্রীলঙ্কা কিংবা পাকিস্তান হতো, তাহলে মুরলীর থেকে অনেক বেশি সাফল্য পেতেন সোনালি চুলের স্পিনার। কেউ কেউ আবার এ–ও বলেন, উপমহাদেশের স্পিন সহায়ক উইকেটেরও দরকার নেই। মুরলী যদি ‘চাকার’ না হতেন, তাহলেও ওয়ার্নের ধারেকাছে আসার ক্ষমতা তাঁর হতো না। দাবিগুলো কি নিতান্তই অযৌক্তিক? পরিসংখ্যান কিন্তু সেকথা বলছে না।
শ্রীলঙ্কার স্পিন সহায়ক ঘূর্ণি পিচে মুরলীর উইকেট তোলার গড় ১৯.৫৭। শিকারসংখ্যা ৪৯৩। সেখানে অস্ট্রেলিয়ার পেস সহায়ক উইকেটে ঘরের মাঠে ওয়ার্নের গড় ২৬.৩৯। পেয়েছেন ৩১৯ উইকেট। এই ওয়ার্ন (Shane Warne) যদি ম্যাচের পর ম্যাচ মুরলীর মতো ধুলোওড়া স্পিনিং ট্র্যাক পেতেন?
চলুন দেখা যাক মুরলী বনাম ওয়ার্নের টেস্ট পরিসংখ্যান। ১৩৩ টেস্টে মুরলীর উইকেটসংখ্যা ৮০০। আর ১৪৫ টেস্টে ওয়ার্নের শিকার ৭০৮ উইকেট। কী মনে হচ্ছে, মুরলী এগিয়ে? কিন্তু ভুললে চলবে না, ৮০০ উইকেটের ১৭৬ টাই এসেছে অপেক্ষাকৃত দুর্বল বাংলাদেশ ও জিম্বাবোয়ের বিপক্ষে খেলে। এই দুটো দলের বিরুদ্ধে ওয়ার্ন খেলেছেন মাত্র ৩টে টেস্ট। পেয়েছেন ১৭টা উইকেট। তাহলে হিসাবটা কী দাঁড়াল?
দাঁড়াল এই যে, বাংলাদেশ ও জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে ম্যাচগুলো যদি হিসাবে না ধরি, তাহলে মুরলীর ঝুলিতে ১০৮ টেস্ট খেলে ২৪.৮৭ গড় নিয়ে ৬২৪ উইকেট পড়ে থাকে। অন্যদিকে ওয়ার্নের থাকে ১৪২ টেস্টে ২৫.৪ গড়ে ৬৯১টি উইকেট।
দু’জনেই সমসাময়িক। দু’জনেই সর্বকালের সেরা। দু’জনেই স্পিনার। দু’জনেরই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে হাজারের বেশি উইকেট! এত মিলের মধ্যেও একমাত্র যেটা অমিল, সেটাই শেন ওয়ার্নের আসনটা মুরলীর থেকে আর একটু ওপরে তুলে দেয়।
বোলিং অ্যাকশন!
ওয়ার্নের অ্যাকশন ছিল নিখাদ ক্রিকেটীয়। তাঁর বোলিং অ্যাকশন নিয়ে অতিবড় সমালোচকও আঙুল তুলতে পারবেন না। অন্যদিকে মুরলীকে দেখুন, চাকিংয়ের অভিযোগে বারবার বিদ্ধ তাঁর কেরিয়ার। মুরলীর দাবি ছিল, তাঁর কনুই জন্মগতভাবেই ব্যাঁকা। তাই চাইলেও তিনি বোলিং অ্যাকশন পাল্টাতে পারবেন না। মনে রাখতে হবে, বারংবার চাকিংয়ের অভিযোগে বিদ্ধ মুরলীর যখন তৃতীয়বার বায়োমেক্যানিক্যাল পরীক্ষা করাতে যাচ্ছেন, তখন আইসিসি–র নিয়ম ছিল, স্পিনাররা সর্বোচ্চ কনুই ভাঙতে পারেন ৫ ডিগ্রি। আর বায়োমেক্যানিক্যাল পরীক্ষা ফল জানাল, সেই সময় মুরলীর কনুই ভাঙে ১৪ ডিগ্রি! প্রায় তিনগুণ।
তারপরেও কীভাবে, কোনপথে মুরলী খেলে গেছেন, জীবনে একবারও বোলিং অ্যাকশন নিয়ে প্রশ্ন না থাকা ওয়ার্নকে কোনওমতে দু’নম্বরে ঠেলে দিতে সক্ষম হয়েছেন— সেটা না হয় ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরাই বলবেন।
মৃত সফল ব্যক্তির দিকে কাদা ছোড়াটা বোধহয় সোশ্যাল মিডিয়ার প্রিয় বিনোদন। যে কোনও নামী তারকার প্রয়াণ ঘটলেই কারা যেন তাঁদের জীবনের যাবতীয় অন্ধকার দিককে টেনে হিঁচড়ে সামনে নিয়ে আসেন। ওয়ার্নই বা তার ব্যতিক্রম হবেন কেন? মাঠে, মাঠের বাইরে অগণিত বিতর্কে জড়িয়েছেন অজিদের প্রিয় ওয়ার্নি। কখনও বুকির সঙ্গে যোগাযোগ, কখনও নিষিদ্ধ মাদক সেবন, কখনও যৌনকেচ্ছা আবার কখনও রিয়েলিটি শো–তে গিয়ে ডারউইনের তত্ত্বকে অস্বীকার করে বসা— এসব বারবারই ঘটেছে। বারবার সমালোচনায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে ওয়ার্নের পাহাড়প্রমাণ উঁচু খ্যাতির বিগ্রহ।
তবু এসবের মধ্যেও মাঠে–মাঠের বাইরে বিপক্ষকে সম্মান করতে নাকি কখনও কসুর করতেন না ওয়ার্ন। তাঁকে এই সার্টিফিকেট কে দিচ্ছেন? না, মাইকেল ভন! ইংল্যান্ডের প্রাক্তন অধিনায়ক। কোন ইংল্যান্ড? না, বাইশ গজে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় শত্রু। অ্যাসেজের মতো মরণ–বাঁচন সিরিজে অজিদের প্রতিপক্ষ। পাকিস্তানের ইমরান খান কিংবা ওয়াসিম আক্রমরা যদি কখনও ভারতের মহম্মদ আজহারউদ্দিন কিংবা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রশংসা করে ফেলেন, তাহলে ব্যাপারটা যেরকম হবে, এটাও ঠিক তেমনই।
ভন তাঁর আত্মজীবনীতে লিখছেন, ‘ওয়ার্নের বিরুদ্ধে খেলা একটা দারুণ অভিজ্ঞতা। কারণ, ও বিপক্ষকে সম্মান দিতে জানে। আপনি যদি ওর বিরুদ্ধে ভাল খেলেন, তাহলে ও আপনাকে অসম্মান করবে না। ওয়ার্ন শুধু আপনাকে বলবে, মারত পারলে মেরে দেখাও। আর যদি আপনি মারতে পারেন, তাহলে ম্যাচ শেষে ও নিজেই এসে বলবে, দারুণ খেলেছ!’
এটাই তো ক্রিকেটীয় স্পিরিট, এটাই তো ক্রিকেটকে ভদ্রলোকের খেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
ক্ষেত্র যা–ই হোক না কেন, যে কোনও কিংবদন্তিরই কিছু ‘সিগনেচার স্টাইল’ থাকে। শাহরুখের যেমন হালকা বেঁকে দু’হাত পাখির ডানার মতো ছড়িয়ে দেওয়া, শচীন তেন্ডুলকরের যেমন অনায়াস কাভার ড্রাইভ, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর যেমন অতর্কিতে অবিশ্বাস্য স্পটজাম্প— তেমনই ওয়ার্নের ছিল গুগলি, ফ্লিপার আর স্লাইডার! শোনা যায়, এগুলোর মধ্যে স্লাইডারটা নাকি শেন শিখেছিলেন আর এক অস্ট্রেলীয় কিংবদন্তি রিচি বেনোর কাছ থেকে চলন্ত ট্রেনে। হাতের কাছে ক্রিকেট বল ছিল না। একটা আপেল ছিল। সেটাকে হাতিয়ার করেই স্লাইডার শিখে নিয়েছিলেন ওয়ার্ন।
যে ওয়ার্ন ছিলেন বিপক্ষের ত্রাস, তিনি একমাত্র সেভাবে সাফল্য পাননি ভারতের বিরুদ্ধে। অবশ্য পাবেনই বা কী করে? ভারতের হয়ে কারা ব্যাট হাতে নামেননি ওয়ার্নের বিরুদ্ধে? ভিভিএস লক্ষ্মণ, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র শেওয়াগ, রাহুল দ্রাবিড় এবং অতি অবশ্যই শচীন তেন্ডুলকর। শচীনের সঙ্গে ওয়ার্নের দ্বৈরথের কাহিনী বাদ দিয়ে তো আর ক্রিকেটের ইতিহাসের সিলেবাস তৈরি করা সম্ভব নয়। এবং সেই ইতিহাসেই থাকবে শচীন সম্পর্কে ওয়ার্নের সেই অমর উক্তি— রাতে দুঃস্বপ্নেও ওয়ার্ন দেখেন, শচীন তাঁর মাথার ওপর দিয়ে বল উড়িয়ে বাউন্ডারি পার করে দিচ্ছেন। নিজে একজন কিংবদন্তি হয়েও অকপটে চিরশত্রুর এহেন প্রশংসা করতেও কিন্তু কলজের জোর লাগে। ওই যে বললাম, বিপক্ষকে সম্মান জানাতে ওয়ার্ন কখনও কুণ্ঠাবোধ করেননি। রাজা সবারে মান দেন বলেই তো সে মান আপনি ফিরে পান।
ভারতের বিরুদ্ধে সব মিলিয়ে ১৪টি টেস্ট খেলেছেন ওয়ার্ন। ৪৭.১৮ বোলিং গড়। পেয়েছেন মাত্র ৪৩টি উইকেট। অন্য টেস্ট খেলিয়ে দেশগুলোর বিরুদ্ধে ওয়ার্নের গড় ৩০ এর চেয়ে কম। সেখানে ভারতের বিপক্ষে কি না ৪৭.১৮!
সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা চলছে, অতিরিক্ত ধূমপান এবং মদ্যপানের সঙ্গে বিশৃঙ্খল–উদ্দাম জীবনযাপনই নাকি ওয়ার্নের জীবনে এত দ্রুত পূর্ণচ্ছেদ টেনে দিল। ওয়ার্নের শারীরিক গঠন কোনও দিনই অ্যাথলিট সুলভ নয়। বরাবরই তিনি নধর হৃষ্টপুষ্ট শরীরের অধিকারী। তার ওপরে মৃত্যুর কিছুদিন আগেই টুইটারে ওয়ার্ন লিখেছিলেন তিনি মেদ ঝরাতে চান। এক ধাক্কায় প্রায় ১৫ কেজি মতো ওজন কমিয়েও ফেলেছিলেন। সেটাই কি কাল হল? একধাক্কায় দ্রুত ওজন কমানোর ঝটকা কি নিতে পারল না মদ্যপান ও ধূমপানে জর্জরিত ওয়ার্নের হৃদযন্ত্র?
ওয়ার্নের মৃত্যুর খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল ওঁর নানা ম্যাচের নানা বোলিংয়ের ভিডিও (যার মধ্যে মাইক গ্যাটিংকে বোকা বানানো সেই বল অফ দ্য সেঞ্চুরিও আছে)। একের পর এক ভিডিও স্ক্রোল করে করে দেখছিলাম। সোনালি চুল হাওয়ায় তিরতির করে উড়ছে। নাকের ডগায় মাখানো সাদা জিঙ্ক অক্সাইড। মৃদুমন্দ গতিতে ধীরে ধীরে হেঁটে এসে সামান্য লাফিয়ে কবজির মোচড়ে ব্যাটারের সামনে ফেলা বলটা বোকা বানিয়ে সাঁ করে বাঁক নিল বাঁ–দিকে। ব্যাটার হয় ব্যাট চালিয়েও বল ছুঁতে পারলেন না কিংবা ছোঁয়ার সাহসই করলেন না। বনবন করে বলটা ঘুরতে ঘুরতে চলে যাচ্ছে কখনও ইয়ান হিলি আবার কখনও অ্যাডাম গিলক্রিস্টের দস্তানায়। সেই বল ফিরিয়ে দিতে দিকে টিভির পর্দায় শোনা গেল স্ট্যাম্পমাইকে ধরা পড়া উইকেটকিপারের সেই অতি পরিচিত প্রশংসাবাক্য— ‘বোলিং ওয়ার্নি..বোলিং’।
ওই ওয়ার্নি–টা আসলে ওয়ার্নিং, সাবধানবাণী। রান আপ ধরে হেঁটে আসছেন বিশ্বের সর্বকালের সেরা লেগ স্পিনার। সাবধান হয়ে যাও ব্যাটার। কোন ডেলিভারি যে স্ট্যাম্প নাড়িয়ে দিয়ে চলে যাবে, কেউ বলতে পারেন না।
পরপারে বসে নিশ্চয় ওয়ার্ন এসব দেখছেন। তিনি কখনও চাইবেন না ক্রিকেট দুনিয়ার আহ্নিক গতি তাঁর প্রয়াণে স্তব্ধ হয়ে যাক। বরং উল্টোটাই। তিনি চাইবেন ‘দ্য শো মাস্ট গো অন’। আবারও নতুন ওভার শুরু করার আগে নীচে ঝুঁকে মাটিতে হাত ঘষে নেবেন কোনও স্পিনার। অল্প দৌড়ে বল আছড়ে ফেলবেন ব্যাটারের সামনে। টার্ন নিয়ে যে বল এগিয়ে যাবে উইকেটের দিকে।
আর হ্যাঁ, যত দিন এই ক্রিকেটগ্রহে একটি বলও ঘুরবে, ততদিন বেঁচে থাকবেন ওয়ার্ন।
কারণ, যে কোনও দেশেরই হোক, যে কোনও স্পিনার ভাল বল করলেই একসময় অবধারিতভাবেই তুলনা টানা শুরু হবে ওয়ার্নের সঙ্গে। কেঠো পরিসংখ্যান যাই বলুক না কেন, ভণিতাহীন স্বচ্ছ স্পিনবোলিং যদি কোনও শিল্প হয়, তাহলে সেই শিল্পের লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি কিংবা মাইকেল অ্যাঞ্জেলো একজনই। মাফ করবেন পাঠক, কোনও মুরলীধরন ওয়ার্নের ধারেকাছেও আসেন না।
রেস্ট ইন পিস শেন কিথ ওয়ার্ন। রেস্ট ইন স্পিন!
