You are currently viewing শীর্ষেন্দুবাবু, ঠিকানাটা প্লিজ বলে দিন

শীর্ষেন্দুবাবু, ঠিকানাটা প্লিজ বলে দিন

Share this post

কলকাতা কিংবা কলকাতার ঘিঞ্জিপনার থেকে অনেকটা দূরে চলে গেলে একটা ছোট্ট তিরতিরে নদী আছে। সেই নদীর ধারে আগাছাভরা জঙ্গল। সেই জঙ্গল লাগোয়া একটা গঞ্জগ্রাম। সেই গ্রামে অদ্ভুতুড়ে সব লোকজনের বাস। তাদের মধ্যে প্রথম হল একটি স্বপ্নালু অথচ ডানপিটে ছেলে। হয়তো যে অঙ্ক পারে না অথবা খুব ভাল ছবি আঁকে। তার কানের কাছে কে যেন সারাদিন ফিসফিসিয়ে মনে করিয়ে দেয় সে অঙ্কে তেরো পেয়েছে।‌
ছেলেটির একজন শিক্ষক আছেন, যিনি পড়ানোর সময় এ প্লাস বি হোলস্কোয়ারের ফর্মুলা ভুলে যান। ছেলেটির বাড়িতে রাশভারী বাবা, স্নেহপ্রবণ মা এবং যৌথ পরিবার। সেখানে পাগলাটে কাকা আছেন, খ্যাপাটে খামখেয়ালি কোনও এক আশ্রিত আছেন। আছে একটা দেশি কুকুর যে যত্রতত্র বেড়াতে গিয়ে হারিয়ে যায়। সন্ধে নামতে এল এদিকে পোষা নেড়িটা এখনও ফিরল না দেখে কুকুরটাকে খুঁজতে বেরয় ছেলেটি। আর সেখান থেকেই শুরু হয় রহস্য। কখনও একটা জাদুকবচ, কখনও একটা জাদু চশমা, কখনও সাধুবাবার ফেলে যাওয়া লাঠি— কী যে কখন বেরিয়ে পড়বে, তার কোনও ঠিক নেই!‌
গ্রামের প্রান্তে জঙ্গলের মধ্যে আছে একটা ভাঙা মন্দির। রাতের বেলা কেউ সেখানে যেতে সাহস পায় না। আর এক প্রান্তে আছে তালপুকুর। যেখানে সারাদিন ছিপ নিয়ে বসে থাকেন মাছপাগল হাবুকাকা। গ্রামের মাঝামাঝি এক চণ্ডীমণ্ডপ, সেখানে থেলো হুঁকো হাতে বসে গল্পগুজব করেন দাদু–জেঠুরা। সেই আড্ডাতেই জানা যায়, গ্রামের কিপটে মহাজন নিতাই সামন্তর বাড়ির আশপাশে নাকি কাল রাতে কয়েকটা সন্দেহজনক লোক দেখা গেছে। যাদের এ গাঁয়ে আগে কোনওদিন দেখা যায়নি। বুড়োদের মধ্যেই একজন এ কথা শুনে মুখের থেকে হুঁকো সরিয়ে বলে উঠবেন, ‘‌এ তো ভাল কথা নয়।’‌
সেই গ্রামেই আছে একটা ভুলো মনের চোর, যে চুরি করতে গিয়ে গেরস্ত বাড়িতে ঘুমিয়ে পড়ে। আছেন একজন ভোলাভালা পুরুতমশাই, যিনি হয়তো পুজো করতে করতে মন্ত্র ভুলে যান। ঘুরে বেড়ান একজন হাটুরে, যিনি মেলায় গিয়ে সেরটাক জিলিপি সাবড়ে দেন। আছেন একজন দারোগা, যিনি এমনিতে দোর্দণ্ডপ্রতাপ হলেও কালীকীর্তন শুনে ফেললে আবেগে গলে গিয়ে লকআপে পোরা চোরের মাথায় হাত বুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে দেন, ‘‌যা ছেড়ে দিলুম, আর চুরিচামারি করিস নে বাপ। তুইও মায়ের সন্তান আমিও মায়ের সন্তান, তোকে শাস্তি দিই কী করে?‌’‌
মোটের ওপরে সেই গ্রামে ছিঁচকে চুরিচামারি বাদে আর কিছু নেই। মাঝেমধ্যে গুপ্তধন কিংবা আশ্চর্য কোনও যন্ত্রের লোভে বাইরের লোক হানা দেয় বটে, তাতে বিশেষ ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। এ সব বিপদ এলে গ্রামের ভোলাভালা মাস্টার, যিনি এ প্লাস বি হোলস্কোয়ারের ফরমুলা ভুলে যেতেন, তিনি আচমকাই শক্তিশালী হয়ে ওঠেন কোনও মন্ত্রবলে। লোকে বলে, গ্রামের যে ভাল ভূত, সেই নাকি স্যারকে ম্যাজিক করে শক্তিশালী করে দেয়। যে ছেলেটি অঙ্কে তেরো পেয়েছিল, আচমকাই কোনও ম্যাজিকে সে হয়ে উঠে সকলের হিরো, সকলের রক্ষাকর্তা। বিপদ কাটলে রাশভারী জ্যাঠামশাই, রাগী বাবা, মুড়িচিঁড়ের হিসেবে গোলমাল করে ফেলা মুদি, কিছুতেই সুর লাগাতে না পারা বেসুয়ো গায়ক, মন্ত্র ভুলে যাওয়া পুরুতমশাই— সকলে একজোট হয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।
সিনেমার সংলাপের আমরা শিখেছি, সিনেমার মতো আমাদের জীবনেও শেষ পর্যন্ত সব ঠিক হয়ে যায়। এই গ্রামেও তাই। গ্রামের মানুষগুলো কেউ ঝাঁচকচকে নন, সাদামাটা নিতান্ত সাধারণ। খেটো ধুতি, ময়লা ফতুয়া, গলায় তেলচিটে কমফোর্টার— এই তাদের বেশভূষা। কাপ থেকে ডিশে ঢেলে ফুঁ দিয়ে খাওয়া চা, একধামা মুড়ি–বাতাসা এই হল তাদের খাবারদাবার। বিকেলে গ্রামের মাঠে হাডুডু আর ফুটবল, শীতের দুপুরে পুরনো বসতবাড়ির ছাদে দেওয়া ঠেস দিয়ে বসে অলসভাবে পাখি দেখা এই তাদের বিনোদন।
আমি এদের খুব ভাল করে চিনি। কিন্তু জানি না ঠিক কোথায় গেলে এঁদের পাওয়া যাবে। এঁদের খোঁজেই আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াই গত দশবছর ধরে। আমি জানি, যেদিন এই গ্রামটা খুঁজে পাব, সেদিন গ্রামের সীমানায় পা রাখা মাত্র লাফাতে লাফাতে এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরবেন ওই অঙ্কে না পারা ছেলেটির আধক্ষ্যাপা ছোটকাকা। ‘‌চলো তোমাকে গ্রাম ঘুরিয়ে দেখিয়ে আনি’‌ বলে আমার ডানহাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যাবে ছেলেটি। সামনে তুরতুর করে হাঁটতে হাঁটতে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে তার পোষা নেড়ি কুকুরটি। ডাইনির বাওড়ের ধারে বসে আমরা গল্প করব, বুড়োশিবতলার ভাঙা মন্দিরের দালানে খেলব এক্কাদোক্কা। শম্ভু মুদির দোকান থেকে কিনে খাব বাতাসা। প্রচুর ঘোরাঘুরির পরে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ব, ছেলেটি বলবে, ‘‌ক’‌টা দিন থেকে যাও আমাদের এখানে।’‌ দুপুরে কড়িবরগার ছাদ আর লাল সিমেন্টের মেঝেতে পিঁড়ি পেতে তুলাইপাঞ্জি চালের ভাত বেড়ে দেবেন ছেলেটির মা। পাশে হাতপাখার বাতাস করবেন তাঁর কাকিমা। খাওয়াদাওয়ার পরে ছেলেটির বাবা হাসিমুখে গল্পেগল্পে জানতে চাইবেন, কোথায় থাকি আমি, কী করি?‌ জানাবেন, ছেলে এমনিতে তাঁর ভালই। শুধু পাটিগণিত আর ইংলিশে গ্রামারটা ধরতে পারছে না। অবশ্য পড়াশুনোয় মন দেয় কই, সারাদিন তো খালি খেলা আর খেলা.‌.‌.‌
এই গ্রামেই শীর্ষেন্দুর গল্পের নায়কের বাড়ি।
এই গ্রামেই আমার শৈশবের বাস।
এই গ্রামেই আমার যতটা সরল হতে চেয়েছিলাম, কক্ষণও ততটা হতে না পারা সারল্যের বসত।
এই যে আমি এত গ্রামে গ্রামে ঘুরি, থাকি, রাত কাটাই, গল্প করি, আসলে আমি খুঁজে বেড়াই সেই গ্রামটাকে খুঁজে বেড়াই আমি। খুঁজে বেড়াই আমি সেই অঙ্কে তেরো পাওয়া ছেলেটাকে, খঁুজে বেড়াই তার সাদাকালো ছোপছোপ নেড়ি কুকুরটাকে। মনে মনে প্রতিশ্রুতি দিই, আর ক’‌দিন পরে যখন গুপ্তধনের খোঁজে বাইরে থেকে লোকজন এসে হানা দেবে আর তোমরা যখন একজোট হয়ে লড়বে, তখন তোমাদের পাশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ব আমিও। হয়ে যাব এই গ্রামের একজন। গ্রামটা গোঁসাইবাগান হতে পারে, হেতমগড় হতে পারে, পটাশগড় হতে পারে, নবীগঞ্জ হতে পারে, অঘোরপুর হতে পারে আবার নবিগঞ্জ কিংবা ঝিকড়গাছা হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
কক্ষণও খুঁজে না পাওয়া সেই গ্রামে অদ্ভুতুড়ে রূপকথার আলোয় ঝলমল করে আছে আমার শৈশবের স্মৃতি। সেই গ্রামের প্রতিটা ঘাস–গাছ–পাতা–ফুল, সেই গ্রামের নদী–মাঠ–বটতলা–স্কুল, সেই গ্রামের ভুলো মাস্টার–আনমনা চোর–দাপুটে দারোগা–রাশভারী বাবা, এদের সবাইকে সবকিছু যিনি হাতে ধরে তৈরি করেছেন, তৈরি করেছেন গোটা এই জগৎটা, সেই আশ্চর্য জাদুকরের আজ জন্মদিন।
শুভ জন্মদিন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। এত কিছু বলে দিলেন, শুধু বললেন না সেই গ্রামের ঠিকানাটা!


Share this post

Leave a Reply