বছর পনেরো–ষোলো পিছিয়ে গিয়ে শুরু করি।
২০০৯–এর শেষ কিবা ২০১০–এর শুরু। বাম সরকার পতন তখন স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। এমনই এক সময়ে কনকনে শীতের সকালে আমার তৎকালীন প্রেমিকাটির সঙ্গে কৃষ্ণনগরের বাসে উঠেছি। কৃষ্ণনগরে আমাদের একটা বাড়ি রয়েছে। সেখানে আত্মীয়দের সঙ্গে প্রেমিকার পরিচয় করানো হবে। খানিক চিংড়ি–মাটন হবে এবং তারপরে ফের সন্ধের ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরে আসব— এই ছিল উদ্দেশ্য।
বাসে ঠাসাঠাসি ভিড়। একটিমাত্র সিট ফাঁকা পাওয়া গেছে। সেখানে প্রেমিকাকে বসিয়ে নিজে সেই সিটের সামনে দাঁড়িয়ে খানিক রসালাপ করছি, এমন সময় বাসে উঠে আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন এক বৃদ্ধ। এমতবস্থায় যা করণীয়, অর্থাৎ যুবতী প্রেমিকাকে অনুরোধ করা, যাতে সে সিটটা এই বৃদ্ধকে ছেড়ে দেয়, তাই করলাম। কিন্তু সেকথা শোনামাত্রই তীব্র আপত্তি জানালেন বৃদ্ধ। কিছুতেই তিনি একজন তরুণীকে উঠিয়ে নিজে সেই সিট দখল করতে নারাজ। নানা কথা, ভবিষ্যতের শুভকামনা, সিট ছাড়ার মানসিকতার জন্য ধন্যবাদ জানানোর ফাঁকে একটি কথা তিনি বলেছিলেন যা আমার লাইন বাই লাইন মনে আছে— ‘কী ভাবছো, আমি বুড়ো হয়ে গেছি? একদম না। আমি এখনও ইয়াং। এখনও অনেকদিন বাঁচব। আর দু’দিন পরে তোমার (আমার তৎকালীন প্রেমিকার দিকে তাকিয়ে) মতোই আর একজন মা আমাদের বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হবে। আমার সেই দুগ্গা মা সবার সব সমস্যা মিটিয়ে মানুষের মুখে হাসি ফোটাবে। এই সবটা দেখে তবে বুড়ো হবো, তারপর মরব।’
আমার বামমনস্ক প্রেমিকাটি এই শুভেচ্ছাবার্তা যে ভালভাবে নেননি, তা বলাই বাহুল্য, কিন্তু আমার হবু সাংবাদিকের মন সেই কথোপকখন ভোলেনি। গ্রামস্তরের মানুষের মমতার প্রতি কী প্রচণ্ড আস্থা ছিল তার নিদর্শন দেখার সেই আমার শুরু।
সেই বৃদ্ধের কথা আজ মনে পড়ছে। বেঁচে আছেন তিনি? থাকলে কেমন আছেন? যে লক্ষলক্ষ মানুষ মমতার মধ্যে সত্যিই ঐশ্বরিক ক্যারিশমা দেখত, বিশ্বাস করত এই ভদ্রমহিলা এলে সব ঠিক হয়ে যাবে, ওই বৃদ্ধ তাঁদের মধ্যে একজন। আরজি কর কাণ্ড এবং কাণ্ড পরবর্তীতে দোষীদের আড়াল ও রক্ষা করার নির্লজ্জ প্রচেষ্টা কি তাঁদের পীড়া দিচ্ছে? যে আস্থা, যে বিশ্বাস চলন্ত বাসে একজন সম্পূর্ণ অচেনা তরুণীর মধ্যে কোনও রাজনৈতিক নেত্রীর ছায়া খুঁজে পায়— সেই বিশ্বাস ও আস্থায় কি আরজি কর কাণ্ডের পর টোল পড়েনি?
মমতা যখন ক্ষমতায় এলেন, বিরোধীদের একটা বড় অংশ বলত, তৃণমূলে একটাই পোস্ট, বাকি সব ল্যাম্পপোস্ট। জনমোহিনী রাজনীতিকদের ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ভাবমূর্তি গঠনের একটা দায় থাকে। মমতার তো ছিলই। একদিকে তিনি যেমন সাধারণ শাড়ি হাওয়াই চপ্পলে নিজেকে পাড়ির মেয়ে প্রমাণের চেষ্টা করেছিলেন, অন্যদিকে ক্ষমতায় এসেই ‘সব কাজ করে দিয়েছি’, ‘৯৫% কাজ হয়ে গেছে’— এই জাতীয় হুংকার দিয়ে বারংবার প্রমাণ করার চেষ্টা করে গেছেন যে তিনি সত্যিই সুপারউওম্যান। যে কাজ ৩৪ বছরে বাম সরকার করতে পারেননি, তা নাকি তিনি ক্ষমতায় আসার দেড়–দু’বছরের মধ্যে সেরে ফেলেছেন।
ওই ‘তৃণমূলে একটাই পোস্ট, বাকি সব ল্যাম্পপোস্ট’–এর মতো দাবি হাওয়ায় আবীরের গুঁড়োর মতো সূক্ষ্ম উড়তে শুরু করল, যখন তিনি নির্বাচনী প্রচারের মঞ্চ থেকে ‘সব কেন্দ্রে আমিই প্রার্থী, আমাকে দেখে ভোট দিন’। এই ধরনের দাবি একদিকে মমতার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছিল, সমঝে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল যে এ রাজ্যের রাজনীতির রাজপথে মমতা যেন শক্তিগড় বা কোলাঘাট! বাস হোক বা প্রাইভেট কার, এখানে থামতে তোমাকে হবেই। অন্যদিকে পরোক্ষে এই বার্তাও দিচ্ছিল, এই দলে মমতার পরে আর কেউ নেই। মমতা শেষ তো দল শেষ।
এলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
মমতার পায়ে চপ্পল, তো অভিষেকের পায়ে ব্র্যান্ডেড স্নিকার।
মমতার পরনে সাধারণ সূতির শাড়ি, তো অভিষেকের গায়ে দামী ব্র্যান্ডের টি–শার্ট
মমতার মুখের ইংরেজি ভাঙা অশুদ্ধ গ্রামারবিহীন, তো অভিষেকের মুখে ইংলিশের খই ফুটছে।
গাড়ি সফরে মমতা দুম করে নেমে রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে নেমে গিয়ে চা বানান, তো অভিষেক আমজনতার থেকে সামান্য দূরত্ব রেখে বুঝিয়ে দেন, তাঁর একটা ওজন আছে। অত চট করে তাঁর কক্ষপথে ঢুকে পড়া যাবে না।
সবচেয়ে বড় কথা, যে দ্রুততায় তিনি রাজনীতির পাঠ সম্পূর্ণ করে প্র্যাকটিকালে ঢুকে পড়লেন, দলের বহুলাংশের রাশ নিজের হাতে নিলেন তা চোখ কপালে তুলে দিতে বাধ্য। দুই, পুরো কাজটা এমন নিঃশব্দে করলেন যে চোখে দেখা গেল বটে, কিন্তু তা নিয়ে কেউ খুব একটা ঢাকঢোলও পেটাতে পারল না মিডিয়া। ওয়ান ফাইন মর্নিং রাজনীতির কারবারীরা দেখলেন, অভিষেকের নামের পাশে যুবরাজ তকমাটা এমনভাবে সেঁটে গেছে যে মমতার সঙ্গেই যাঁদের ক্ষমতার অলিন্দে উত্থান হয়েছিল সেই পার্থ (তখনও জেলে যাননি), সেই ববি (তখনও হাজতবাস করে রাজনৈতিক ঝাঁঝ হারিয়ে ফেলেননি), মুকুল রায় (তখনও তৃণমূল মানেই বিজেপি, বিজেপি মানেই তৃণমূল বলে ফেলে তাঁর মানসিক ভারসাম্যের সমস্যা সামনে এনে ফেলেননি), সেই শুভেন্দু (তখনও বিজেপি–তে চলে যাননি)— মানে দলে যাঁদের স্থান মমতার ঠিক পরেই (হয়তো নিজেদের মধ্যে নীরব প্রতিযোগিতাও চলত যে মমতার পরে কুর্সিটি কার দখলে আসবে), সকলেই খেয়াল করলেন, এই দৌড়ে তাঁদের অজান্তেই ফিনিশিং লাইন ক্রস করে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। বাকিরা ক্রমে অপ্রাসঙ্গিক হতে শুরু করলেন। একমাত্র মদন মিত্র টিঁকে রইলেন। রাজনৈতিক গুরুত্ব হারালেন বটে। সবার আগে ব্যাপারটা বুঝলেন শুভেন্দু অধিকারী। ভাল প্রোমোশনের সুযোগ না থাকলে যেমন লোকে কোম্পানি বদল করে, শুভেন্দুও দল বদল করে নিলেন।
বাংলার রাজনীতি দুটো জিনিস বুঝে গেল। এক, এই দল মমতাতেই শেষ নয়। দুই, এরপর যিনি আসবেন, তিনি আরও আরও রাফ অ্যান্ড টাফ।
অভিষেককে কখনও দেখবেন না, মমতার মতো অম্বা–ডম্বা–রম্বা কবিতা লেখার চেষ্টা করছেন। নিজেকে ‘আমি সব পারি, আমি সব জানি’ জাতীয় কথা বলে অবাস্তব দাবি করছেন। অভিষেক এটুকু জানেন এবং বিলক্ষণ বোঝেন, জ্যাক অফ অল ট্রেডস, মাস্টার অফ নান। মমতা ছবি আঁকা–গান লেখা–কাব্যচর্চা করে নিজেকে অলরাউন্ডার প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন। তো অভিষেক নীরবে এই বার্তা দিচ্ছেন, তিনি একটাই জিনিস পারেন। তা হল রাজনীতি। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার জন্য ওটুকুর বেশি আর কিছু দরকার পড়ে না।
কেমন রাজনীতি পারেন অভিষেক? নমুনা এক, রাজনীতির মূল কথাই হল, ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’। তুমি রিগিংয়ে জিতেছো না ছাপ্পায় জিতেছো তা কেউ মনে রাখবে না। যা মনে রাখব, তা হল ডায়মন্ডহারবার থেকে তুমি জিতেছো। রেকর্ড ভোটে জিতেছো। রিগিংয়ের অভিযোগ উঠেছিল বটে। তবে তা কেউ মনে রাখেনি। মনে রাখবেও না।
নমুনা দুই, খেয়াল করবেন, অভিষেক হাসেন না। লঘু রসিকতা করেন না। বক্তব্য রাখার সময় মমতার মতো লম্বা বাক্য বলেন না। তিনি তাঁর কাজ করেন নীরবে, নিঃশব্দে। বুঝিয়ে দেন, মমতাকে নিয়ে যে লঘু রসিকতাগুলো করা চলে, তিনি সেসব জায়গায় রসিকতার সুযোগই দেবেন না।
ঠিক সেই কারণেই একদিকে যখন মিছিলে মিছিলে দাবি উঠছে ‘দাবি এক দফা এক মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ’ ঠিক তখনই অভিষেকের তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য (সূত্র আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮ অগস্ট) প্রশাসনের শীর্ষস্তরে বদল ছাড়া দল ও সরকারের পক্ষে এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। পাশাপাশি এবিপি আনন্দও খবর করেছিল, ডায়মন্ডহারবারে একাধিক তৃণমূল নেতা ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন অভিষেককে ক্ষমতায় দেখতে চেয়ে।
কোন ডায়মন্ডহারবার? না, যে কেন্দ্র থেকে অভিষেক সাংসদ। রেকর্ড ভোটে জিতে সাংসদ।
মমতা কি পদত্যাগ করবেন? তারচেয়েও বড় প্রশ্ন হল, অভিষেক কি আর অপেক্ষা করবেন? দলের রাশ যে এখন অনেকটাই অভিষেকের হাতে তা এখন নার্সারিতে পড়া শিশুরা ছাড়া সবাই জানে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিন্দাবাদের পাশাপাশি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জিন্দাবাদের স্লোগান কোনও দলীয় হুইপ ছাড়াই কর্মীদের মুখে মুখে ঢুকে পড়েছে।
ক্ষমতায় থাকতে থাকতেই কুর্সির হস্তান্তর কোনও নতুন কথা নয়। কিন্তু যেভাবে অভিষেক মমতাকে রিপ্লেস করবেন, সেই প্রসেসটি বড় ইন্টারেস্টিং। মমতা জনআন্দোলন করে উঠেছেন। ক্ষমতায় না থাকা অবস্থায় মিটিং মিছিল ধরনা ঘেরাও করে এসেছেন। নিগৃহীতা হয়েছেন। লাঠির বাড়ি খেয়েছেন। পথে বসে অনশন করেছেন। একেবারে শূন্য থেকে দলীয় সমর্থনের পোক্ত ভিত গড়েছেন। যার ফল হল, গ্রামে–গঞ্জে মমতা কার্যত দেবীর আসন পেয়েছেন।
অভিষেক যখন আসবেন, মমতার আন্দোলনের ডিভিডেন্ড তাঁর পকেটে থাকবে ঠিকই, তবে চ্যালেঞ্জও থাকবে। মমতা যদি সত্তরের রোম্যান্টিক ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট হন, অভিষেক তবে লেট নাইন্টিজের নিষ্ঠুর পেশাদার অস্ট্রেলিয়া। দু’জনেরই লক্ষ্য জেতা। তবে ক্রিকেটের ব্র্যান্ডটা আলাদা।
বাসে আলাপ হওয়া সেই বৃদ্ধ কি বেঁচে আছেন এখনও? রাজনীতির খবরাখবর রাখেন? জানতে ইচ্ছে করে, খুব জানতে ইচ্ছে করে এই পরিবর্তনকে তিনি কীভাবে দেখছেন।
