You are currently viewing চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন থেকে ‘‌যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’‌,‌ বিপ্লবী থেকে ডাকাত অনন্তের জীবন নিয়ে আসছেন জিৎ

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন থেকে ‘‌যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’‌,‌ বিপ্লবী থেকে ডাকাত অনন্তের জীবন নিয়ে আসছেন জিৎ

Share this post

খবরটা নিউজফিডে ভেসে আসতেই খানিক চমকে উঠলাম। সত্যিই তাহলে কেউ অন্তত মনে রেখেছে ওঁকে। নইলে বিস্মৃতির অতলে ডুবে যাওয়া এমন একটা চরিত্রকে নিয়ে কেউ সিনেমা বানানোর কথা ভাবে?‌
কোন খবর?‌ না,পরিচালক পথিকৃৎ বসু যিনি এই কদিন আগেই ‘‌দাবাড়ু’–র মতো ছবি বানালেন, তাঁর এবারের কাজ ‘কেউ বলে বিপ্লবী, কেউ বলে ডাকাত’। অর্থাৎ বিপ্লবী অনন্তলাল সিংয়ের আত্মজীবনী থেকে সিনেমা বানাচ্ছেন তিনি।
অনন্তলাল সিংয়ের বায়োপিক!‌ সেই অনন্তলাল সিং, যাঁকে জীবনের শেষ প্রান্তে ডাকাতির দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছিল!‌ সেই অনন্তলাল সিং, যিনি ‘‌যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’‌–এর মতো কালজয়ী সিনেমার প্রযোজক ছিলেন!‌ সেই অনন্তলাল সিং, যাঁকে গুরু বলে মানতেন অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও হাজার বিপ্লবীর মতোই ন্যায্য প্রাপ্য সম্মান জীবদ্দশায় পাননি অনন্ত। কিন্তু ওঁর কথা জানা দরকার আমাদের সকলের। কত বড় বিপ্লবী, কতটা দুঃসাহসী— এসবের পাশাপাশি, বন্ধু হিসেবে বন্ধুর জন্য অনন্ত কত বড় আত্মত্যাগ করে গেছিলেন, জানা দরকার সেটাও।
এই গল্পটা জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে ৯৫ বছর আগে ১৯৩০ সালে। পুলিশ হেড কোয়ার্টার লালবাজারে গোয়েন্দাকর্তা লোম্যানের টেবিলে একটি চিঠি রেখে গেলেন এক বেয়ারা। রেখে যাওয়া চিঠিটা খোলার পরেই প্রায় লাফিয়ে উঠলেন লোম্যান। চিঠিটা যিনি লিখেছেন, তাঁকে হাতের নাগালে পেলে গোটা পুলিশ দফতর হাঁফ ছেড়ে তো বাঁচবেই, লোম্যানের পদোন্নতিই বা ঠেকায় কে!‌ যে নামে ব্রিটিশ পুলিশের গোয়েন্দাদের হাঁটু কাঁপে, সেই তিনিই নাকি নিজে এসে ধরা দেবেন!‌ ব্যাপারটা ভাবতেই লোম্যানের ঘনঘন শ্বাস পড়তে লাগল লোম্যানের।
চিঠিতে লেখক হিসাবে সইতে যে নামটা লেখা আছে, সেটা আরও একবার দেখে নিলেন লোম্যান — ‘‌অনন্তলাল সিং’‌। পূর্বপুরুষরা আগ্রার বাসিন্দা হলেও চলে এসেছিলেন বাংলায়। অনন্তের জন্মও চট্টগ্রামে। যিনি স্কুলে পড়ার সময়েই শিখে ফেলেছিলেন বোমা বানানোর কৌশল। বিপ্লবীদের অর্থসাহায্য করার জন্য ট্রেন লুট করেছেন। হয়ে উঠেছেন মাস্টারদা সূর্য সেনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে একটি দলের নেতৃত্বও দিয়েছেন সূর্য সেনের সঙ্গে। সেই অনন্তলাল নাকি আত্মসমর্পণ করতে চাইছেন!‌
কিন্তু আত্মসমর্পণ?‌ ব্যাপারটা তো ঠিক সেই রকম লাগছে না। কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম প্যাঁচ রয়েছে।
চিঠিটা ফের টেনে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন লোম্যান।
‘‌প্রিয় মি.‌ লোম্যান,
২৮ জুন আমি তোমার সঙ্গে দেখা করব। আমি নিশ্চিত, সেদিন আমাকে গ্রেপ্তারের সুযোগ তুমি হাতছাড়া করবে না। আমি অবশ্য তার জন্যও প্রস্তুত রয়েছি। তবে এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে, আমি আত্মসমর্পণ করছি। লোকে কখন আত্মসমর্পণ করে?‌ যখন সে অসহায় হয়ে পড়ে কিংবা তার সামনে আর কোনও পথ থাকে না, তখনই সে নত হয়।’‌
মাথায় রক্ত চড়ে গেল লেম্যানের। একে তো ফেরারি আসামি, তার ওপরে ব্রিটিশ সরকার যদি এই অনন্তলাল সিংকে সামনে পায়, গুলি করে মারবে। তার এত আত্মবিশ্বাস আসে কোথা থেকে?‌ ভুরুটা কুঁচকে ফের চিঠিটা পড়তে শুরু করলেন লোম্যান। অনন্ত লিখেছেন, ‘‌আমি কি এখন অসহায়?‌ একেবারেই না। আমার হাতে আত্মরক্ষার অস্ত্র আছে। সঙ্গে তেমনই খরচ করার জন্য প্রচুর অর্থও আছে। আমাকে সাহায্য করার জন্য লোকেরও অভাব নেই। এমনকী, আমি যদি এই রাজ্য কিংবা দেশের বাইরেও চলে যাই, তাহলেও আমাকে সহযোগিতা করার লোকের কোনও অভাব হবে না। তবুও আমি হাসিমুখে গ্রেফতারি বরণ করব।’‌
তাহলে কি অনন্তলালের দলের নেতারাই এই নির্দেশ দিয়েছেন?‌ নাহ, সেটাও ভুল। কারণ অনন্তলাল লিখেছেন, ‘‌তুমি কি ভেবেছো, যা করেছি, তার জন্য আমি অনুতপ্ত?‌ একদম না। এটাও ভেবো না যে, আমার দল আমাকে এই কাজটা করতে বলেছে। আমি যা করছি সেটা সম্পূর্ণভাবেই আমার একার সিদ্ধান্ত এবং কারণটা গোপনই থাকবে।
ইতি,
অনন্তলাল সিং’‌
এতো বড় সহজ কথা নয়। অনন্তলাল সিং চাইছেনটা কী!‌ ব্যাপারটা বোধগম্যই হচ্ছিল না লোম্যানের। ভারতীয়দের সম্পর্কে লোম্যানের অসীম অবজ্ঞা। তবে সেটা মুখে। ভিতরে ভিতরে লোম্যান বিলক্ষণ জানতেন, মাস্টারদা সূর্য সেন এবং তাঁর সহযোগীরা যে ধাতুতে গড়া, তাতে যে কেউ যে কোনও কিছু করে ফেলতে পারেন। অতএব, ওদের বিশ্বাস নেই।
মনে মনে কুটিল অঙ্ক কষতে শুরু করলেন লোম্যান। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুটের ঘটনাটা ঘটেছিল ১৮ এপ্রিল। এরপরে দশ–দশটা দিন কেটে গেছে। মূল মাথা সূর্য সেন তখনও পুলিশের নাগালের বাইরে। কয়েকজনকে অবশ্য গ্রেপ্তার করতে পেরেছে লোম্যানের দলবল।
সূর্য সেনের হদিশ পেতে জালে ধরা পড়া বিপ্লবীদের ওপর অমানবিক অত্যাচার চালানো হচ্ছে। চিঠির লেখক অনন্তলাল সিংকেও চট্টগ্রামের কাছে ফেনী রেলস্টেশনে প্রায় ধরেই ফেলেছিল ব্রিটিশ পুলিশ। অস্ত্রাগার লুঠের পরে ছোটছোট দলে ভাগ হয়ে গা ঢাকা দিচ্ছিলেন বিপ্লবীরা। আচমকাই পুলিশের সামনে পড়ে যায় অনন্তের দলটি। সিংহবিক্রমে দু’‌হাতে দু’‌টি বন্দুক তুলে নিয়ে নিয়ে এমন গুলিবর্ষণ করলেন, পুলিশের দলই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। তার দশদিনের মধ্যে এমন কী ঘটল যে অনন্তলাল যেচে ধরা দিতে চাইবেন?‌ অনন্ত কি জানেন না, ধরা পড়া বিপ্লবীদের থেকে সূর্য সেনের ঠিকানা বের করার জন্য কী অমানবিক নির্যাতন চলছে ব্রিটিশদের জেলে।
আসল কারণটা বুঝতে পারেননি লোম্যান। পারার কথাও না। আসল কারণটা ছিল বন্ধুত্ব। অনন্তের শর্ত ছিল, ধরা তিনি দেবেন। কিন্তু তাঁর বিনিময়ে এটা নিশ্চিত করতে হবে, ধরা পড়া বিপ্লবীদের কাউকে ফাঁসি দেওয়া যাবে না। তখনও সূর্য সেন ধরা পড়েননি। পড়লে হয়তো তাঁরও ফাঁসি হতো না। ইতিহাসের বাইরে একটা ইতিহাস থাকে, যার পোশাকি নাম জনশ্রুতি। সেই জনশ্রুতিই বলে, ধরা পড়া সঙ্গীদের যাতে একজনেরও ফাঁসি না হয়, সেটা নিশ্চিত হয়েছিল এই অনন্তেরই কূটনীতিতে।
বন্ধুদের প্রাণ বাঁচালেন অনন্ত। অন্যদিকে জেলের মধ্যেই বন্দি অবস্থায় এমন আন্দোলন শুরু করে দিলেন, যে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল পুলিশ। কখনও সদলবলে সারাদিন বন্দেমাতরম ধ্বনি তুলে স্লোগান দিচ্ছেন। কখনও অনশন করছেন। প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে গেল জেল কর্তৃপক্ষের। আত্মগোপন করে থাকলে তবু নিঃশব্দে থাকতে হয়। জেলের মধ্যে সে দায়ও নেই। অতএব, করো পুলিশের প্রাণ ওষ্ঠাগত।
আসলে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ব্রিটিশদের কাছে যত না ভয়ের, তারও চেয়ে বেশি লজ্জার। দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্রিটিশের নাকের ডগায় বসে কেউ এতবড় কাণ্ড করে ফেলতে পারে, তা তাঁদের চেতনার বাইরে। এদিকে, এই ঘটনার পর সারাদেশের মানুষ উত্তেজনায় ফুটছেন। তাঁদের সমর্থন বিপ্লবীদের দিকে। তাই অনন্তদের ফাঁসিও দেওয়া যাচ্ছে না। তাতে যদি জনরোষ তৈরি হয়?‌ ফের যদি বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের মতোই আরও কোনও বড় কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেন। এঁদের তো আর প্রাণের ভয় নেই।
তখন ঠিক করা হল, ফাঁসি নয়, দ্বীপান্তরে পাঠানো হবে ধরা পড়া বিপ্লবীদের। দেশবাসী অবাক হয়ে দেখলেন, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে গ্রেফতার হওয়া বিপ্লবীদের একজনেরও ফাঁসি হল না। হল কালাপানির সাজা। লোকনাথ বল, গণেশ ঘোষ, লালমোহন সেন, সুবোধ চৌধুরী, ফণিভূষণ নন্দী, আনন্দ গুপ্ত, ফকির সেন, সহায়রাম দাস, বনবীর দাশগুপ্ত, সুবোধ রায়(ঝুংকু) এবং সুখেন্দু দস্তিদারের সঙ্গে আন্দামানের জাহাজে চড়িয়ে দেওয়া হল অনন্তকেও। লোম্যানরা ভাবলেন, ‘‌বাঁচা গেল, আপদ বিদায় হল।’‌
কিন্তু এত সহজ বান্দা ছিলেন না অনন্ত। যিনি বন্ধুদের ফাঁসি রুখতে হাসিমুখে পুলিশের হাতে ধরা দেন, তাঁকে কি আর আন্দামানের জেলে চার দেওয়ালের মধ্যে শান্ত রাখা যায়?‌ সেলুলার জেলেও ফের আন্দোলন শুরু করলেন অনন্ত। তাঁদের দমাতে অমানবিক অত্যাচার শুরু করল পুলিশ। আন্দোলন চরমে উঠলে ফুঁসে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধীরা। আন্দামান থেকে ফিরিয়ে আনা হল অনন্তদের। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৬ সালে কারাবাস থেকে মুক্তি পেলেন অনন্ত।
ততদিনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত টলে গিয়েছে। ব্রিটিশ শাসনের শেষ হতে বাকি মাত্র একটি বছর।
এই দীর্ঘ কারাবাসে আন্দোলনের পাশাপাশি মার্কসবাদী দর্শনের চর্চা করেছেন অনন্ত। পড়েছেন একের পর এক বই। তাই স্বাধীনতার পরে যোগ দিলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। কিন্তু সেখানেও বেশিদিন থাকলেন না। বরং রাজনীতি থেকেই নিজেকে বেশ কিছুটা সরিয়ে নিলেন। কিছুদিন করলেন গাড়ির ব্যবসা। তারপর অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন বাংলা সিনেমার জগতের সঙ্গেও।
এই ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন অনন্তের গুণমুগ্ধ। গুরুর মতো শ্রদ্ধা করতেন অনন্তকে। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় মেয়ের বিয়ের দিন নিজে হাতে করে বিয়ের ভোজের খাবার জেলে নিয়ে গিয়েছিলেন অনন্তের জন্য। অনন্তেরও অপার স্নেহ ছিল ভানুর ওপরে। ‘‌যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’‌, ‘‌শখের চোর’, ‘নতুন প্রভাত’, ‘শেষ পরিচয়— এই ফিল্মগুলির প্রযোজকও ছিলেন তিনি। কিন্তু ফের সব বদলে গেল।
ততদিনে দেশ স্বাধীন হয়েছে। অনন্ত সম্ভবত মনে করেছিলেন, যে স্বাধীনতার জন্য তাঁরা লড়াই করেছিলেন, সেই স্বাধীনতা নেই। ১৯৫৯ সালে খাদ্য আন্দোলনে অসংখ্য অসহায় মানুষদের সাহায্য করতে অনন্ত সিংহ সংগঠন গড়ে দরিদ্র দেশের মানুষের সেবা করার কাজ শুরু করেছিলেন। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি নিজে একপ্রকার নিঃস্ব হয়ে গেছিলেন। তিনি দেখলেন দেশে একদলের কাছে শুধু টাকা আর টাকা, অন্যদিকে একদল প্রায় খেতেই পায়না, অথচ স্বাধীন দেশের সরকার কোনও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। স্বাধীন দেশেই অসহায় মানুষ শুধু না খেতে পেয়ে একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে— এই স্বাধীনতা তারা চাননি বলেই অনন্ত সিংহের মনে হয়েছিল। দেশভাগ, স্বাধীনতার পরেও ব্রিটিশ শাসনের ফেলে যাওয়া দারিদ্র্য তাঁকে অসীম যন্ত্রণা দিত। তাই অনন্ত গোপনে তৈরি করলেন ‘‌ম্যানমানিগান’ নামে একটি উগ্র বামপন্থীদল। দরিদ্র মানুষের খাদ্যবস্ত্র জোগাড় করার জন্য ব্যাংক ডাকাতি করত এই দলটি। অনন্ত মনে করতেন, দেশের সম্পদে দেশের সব মানুষের‌ অধিকার থাকা উচিত। বেশ কয়েকটি ডাকাতি হওয়ার পরে সরকারের টনক নড়ে। ঝাড়খণ্ডের জাদুগোড়া থেকে অনন্তকে ১৯৬৯ সালে গ্রেপ্তার করা হয় এবং জেলে পাঠানো হয়। অনন্তের নিজের কথায়, ‘‌অপরাধ তো অপরাধই হয়, সে যে জন্যেই হোক, কারণটা কেউই বুঝবে না।’‌ দরিদ্র মানুষের জন্য অনন্তের অর্থ সংগ্রহের পদ্ধতিটি বিতর্কিত হলেও, তাঁর উদ্দেশ্য যে সৎ ছিল, তা অনেকেই মানেন।
লেখার পরে ছবি বাছতে গিয়ে দেখলাম, এত কম লেখা হয়েছে অনন্তলাল সিং–কে নিয়ে, যে গুগলে একটা ভালো ছবি পর্যন্ত নেই ওঁর।
অবশ্য তাতে অনন্তলাল সিংদের কিছু আসে যায় না। শেষ অবধি একটা গোটা সিনেমা তো হচ্ছে ওঁকে নিয়ে।


Share this post

Leave a Reply