You are currently viewing রূপকথা নয়, রূপ‘‌ম’‌কথা শেখালো ‘‌এন্ড তক সব ঠিক হি হো যাতা হ্যায়’‌

রূপকথা নয়, রূপ‘‌ম’‌কথা শেখালো ‘‌এন্ড তক সব ঠিক হি হো যাতা হ্যায়’‌

Share this post

নিয়তি তোমাকে বুটের তলায় পিষবে। প্রকাশ্য রাস্তায় গায়ে থুতু দেবে, কৌপিনটুকুও কেড়ে নিতে কসুর করবে না।
তোমার সামনে দুটো রাস্তা। হয় পরাজয় স্বীকার করে নাও। নিজেকে শেষ করে দাও। হার স্বীকার করে ঘরের কোণে পড়ে থাকো।
নয়তো, উঠে দাঁড়াও গায়ের ধুলো ঝেড়ে। রক্তাক্ত শরীরে হাতের চেটো দিয়ে কষ থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত মুছতে মুছতে শপথ নাও, খেলা এখানে শেষ নয়। আমি ফিরে আসব। ঘুরে দাঁড়াব। যখন আসব, রাজার মতো উঠে দাঁড়াব, গোটা দুনিয়া চোখ কচলে দেখবে। ফিসফিসিয়ে আলোচনা করবে, ‘‌পারল কী করে লোকটা?‌ এও সম্ভব?‌’‌
সম্ভব। চোখের সামনেই তো দেখলাম গতকাল সন্ধ্যায়। প্রায় ১২০০ দর্শকের সামনে দিয়ে রূপম যখন হেঁটে আসছেন মঞ্চে উঠবেন বলে, গোটা অডিটোরিয়াম ‘‌স্ট্যান্ডিং ওভেশন’‌ দিচ্ছে তাঁকে। সেই কলামন্দির, যেখানে আজ থেকে ৩০ বছর আগে মঞ্চ থেকে টেনে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে মাত্র দেড়খানা গান গাওয়ার পরে। আজ থেকে ৩০ বছর আগে যেখানে ১২০০ জোড়া চোখ তাঁকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেছিল, সেখানেই আজ ১২০০ জোড়া চোখে তাঁর জন্য এক সমুদ্র সম্মান, সম্মোহন, আবেগ।
সেই কলামন্দিরে কোনও কোনও দর্শক আসন ছেড়ে উঠে তাঁর পায়ের সামনে লুটিয়ে পড়ছে, জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছে। রূপম তাঁদের সস্নেহ শাসনে বলছেন, ‘‌এসব করিস না। এসব করলে আমিও সেই ‘আধ্যাত্মিক গুরুই’ হয়ে যাব, যা আসলে আমি হতে চাই না।’‌ আশপাশে কারও চোখে জল, কেউ উত্তেজনা–আবেগে থরথর করে কাঁপছেন।
বেস্ট এন্ট্রি অফ রূপম ইসলাম একক টিল ডেট?‌
উত্তর নিঃসন্দেহে হ্যাঁ।
অনুষ্ঠান শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই যান্ত্রিক গোলযোগ। বিরক্ত, অসহায় রূপম উঠে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হলেন মঞ্চ থেকে। বেশ কিছুক্ষণের বিরতি, যন্ত্র সারানোর চেষ্টা চলল আলো কমিয়ে। তারপর, রূপম ফিরলেন।
তখনও কি সব ঠিক?‌ না। যন্ত্র তখনও ভুগিয়ে যাচ্ছে। নিজে যা গাইছেন, সামান্য দেরিতে আসছে মনিটরে— ফলে শুনতে হচ্ছে ঠোক্কর খাওয়া কৃত্রিম আওয়াজ। গিটার টোনে অদ্ভুত এক স্ল্যাপ ব্যাক ডিলে। কানে পীড়া দিচ্ছে ঝনঝনে শব্দ। বারবার বলার পরেও দিশেহারা সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার। এই একই সেট আপ তো ব্যবহৃত হয়েছিল খাস একক ১–এ। তখন কোনও গড়বড় হয়নি। তাহলে এখন কেন?‌
যন্ত্রবিভ্রাটের সময় আসন ছেড়ে উঠে এসেছিলেন অতিথি–দর্শক দেবজ্যোতি মিশ্র। আমাকে সামনে পেয়ে জামার আস্তিন খামচে ধরে উদ্‌ভ্রান্তের মতো প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‌এই ভাই, কনসোলটা কোনদিকে?‌ নিয়ে চলো তো আমাকে। আমি দেখছি কী সমস্যা হয়েছে।’‌ সেদিকে নিয়ে যেতেই বোর্ডের ওপর ঝুঁকে পড়ে গলদ মেরামতের চেষ্টায় লেগে পড়েছিলেন।
মঞ্চে উঠে গান কিংবা বাজান যাঁরা, তাঁরা সহজেই অনুমান করতে পারবেন এটা কত বড় সমস্যা। নিজের কণ্ঠ যদি শিল্পী নিজে শুনতে না পান অথবা নিজের হাতের ইনস্ট্রুমেন্ট যদি অপরিচিত কটূ টোনে বাজতে থাকে ইন ইয়ার মনিটরে তাহলে কতটা অসহায় লাগে, তা বলে বোঝানো ভীষণ কঠিন।‌ সহজ উদাহরণে এটুকু বলা যায়, আপনি কথা বলছেন, কিন্তু নিজের স্বর নিজে শুনতে পাচ্ছেন না।
এমতবস্থায় যে কেউ কথা বলা বন্ধ করে দেবেন। গান, তাও আবার ১২০০ লোকের সামনে?‌ সম্ভবই নয়। রূপম তাও কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ফিরে এলেন। কিছুই করা আর সম্ভব নয় বুঝে অনর্গল
গেয়ে চললেন। বলে চললেন।
এথেন্স আর স্পার্টার গল্প জানেন তো?‌ প্রাচীন গ্রিসের দু’‌টি শহরের বড় নামডাক হয়েছিল— এথেন্স আর স্পার্টা। এথেন্স ছিল শিল্পকলা, দর্শন, সাহিত্যের চর্চার জন্য বিখ্যাত। আর স্পার্টা বিখ্যাত ছিল তার লড়াকু মানসিকতার জন্য। হারার আগে হারব না, শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করব, অসম্ভব যুদ্ধকে সম্ভব করে জিতে দেখাব— এই ছিল স্পার্টানদের নীতি।
রূপম একজন প্রকৃত স্পার্টার্ন। তাঁর অনুষ্ঠান যেখানে সাজানো কি–বোর্ড এবং গিটার দিয়ে। কিছুগান কি–বোর্ড বাজিয়ে গাইবেন, কিছু গান গিটার বাজিয়ে গাইবেন। গিটারের মধ্যে আবার ইলেকট্রিক এবং অ্যাকুস্টিক— দু’‌রকমই আছে।
যান্ত্রিক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে কি–বোর্ডের পথই আর মাড়ালেন না রূপম। বাজালেন শুধু অ্যাকুস্টিক গিটার, যা হাতের জোর কমিয়ে বাড়িয়ে খানিকটা কনট্রোল করা যায়। মানে, আপনি ঢাল আর তরোয়াল নিয়ে যুদ্ধ করতে নেমেছেন। আচমকাই যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে দেখলেন, ঢালটা কাজ করছে না। যা লড়াই, সেটা শুধু তরোয়ালেই করতে হবে। এটাও সেরকম। রূপম তাও লড়লেন। ইলেকট্রিক গিটারের টোন হেভি। তাতে শব্দ দু’বার এলে বেশি জড়াবে। তাই তা ত্যাগ করলেন বিনা বাক্যব্যয়ে। লড়ে গেলেন শুধু অ্যাকুস্টিক গিটারকে সম্বল করে।
জিতলেনও।
আপনি যদি প্রথাগত দৃষ্টিতে দেখেন, আপনি যদি আম (‌সাধারণ অর্থে)‌ দৃষ্টিতে দেখেন, তাহলে মনে হবে, ‘‌এহ, এরকম একটা স্পেশ্যাল শো, আর সেটাই কি না বিগড়ে গেল?‌’‌
আর যদি খাস (‌বিশেষ অর্থে)‌ দেখেন, তাহলে মনে হবে, ‘‌সাবাশ এই তো চাই। রক মিউজিক তো সকলের জন্য নয়। রক মিউজিকের যাত্রা কবেই বা ফুলছড়ানো পথে হয়েছে। রক মিউজিকের তো পথে ভাঙা কাচ পড়ে থাকে। তাই এটাই রূপমের প্রতিশোধের প্রত্যাবর্তনের আদর্শ পরিবেশ।’‌
ইলেকট্রিক গিটারের বদলে অ্যাকুস্টিক এবং কি–বোর্ডে হাত না ছুঁইয়েই রূপম যে কাণ্ডটা করে গেলেন, যেভাবে কোনও ব্রেক ছাড়াই ওইরকম গড়বড়ে সাউন্ডে টানা তিনঘণ্টা গেয়ে–বলে গেলেন, সেসব দেখেশুনে মনে হচ্ছিল.‌.‌.‌ সাবাশ, এই তো চাই।
শুরুতে নিয়তির কথা বলছিলাম না, নিয়তি এইভাবেই স্টেজ থেকে টেনে নামিয়ে দেবে। রূপম স্পার্টানের মতো লড়ে সেই মঞ্চ সসম্মানে ফেরত নেবেন। নিয়তি ফের সাউন্ডে গড়বড় করিয়ে দেবে। রূপম সাউন্ড ও ইনস্ট্রুমেন্টের তোয়াক্কা না করে তবুও জমিয়ে দেবেন— এটাই তো রক মিউজিকের ভবিতব্য। রক মিউজিক তো এভাবেই হয়।
রক মিউজিকের ধারক ও বাহক যাঁরা, সেই যন্ত্রণাপ্রজাতি চলার পথে কাচ পড়ে থাকে। সে সব মাড়িয়েই তাদের এগোতে হয়। রূপম তো তার বাইরে নন। তাই নিয়তি যতই গড়বড় করুক, রূপম যতই ক্ষুব্ধ হন, ৩০ বছর পর প্রত্যাবর্তনের মঞ্চে এই গড়বড়ের চেয়ে বড় সমাপাতন এবং আদর্শ পরিবেশ আর হতেই পারে না। এই যান্ত্রিক গোলযোগ দুটো জিনিস বুঝিয়ে দিল।
১)‌ রক মিউজিকের নিয়ম মেনেই তার যাত্রাপথ সুগম হবে না।
২)‌ আমরাও বুঝে নিলাম, রূপম ইসলাম আসলে কী জিনিস!‌ বুঝে নিলাম, স্রেফ টেকনিকালিটিজ দিয়ে আর একটা রূপম ইসলাম বানানো যায় না।
আমি বারবার বলি, এই দুনিয়া এথেন্স নয়। এই দুনিয়া স্পার্টা। এখানে বাঁচতে হলে স্পার্টানদের মতো করেই বাঁচতে হবে। যদি কোনও সুখী মিনমিনে গানের টুংটাং আপনাকে এই বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করে, সব কিছু তুমি ফুলেল রাস্তায় হেঁটে পেয়ে যাবে, তাকে বর্জন করার শিক্ষাই রূপম আমাদের দেন। হ্যাঁ, সৎ থাকলে, নিজেকে হারিয়ে না ফেললে, দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে গেলে যা চাইছি, তা নিয়তিই আমাকে ফিরিয়ে দেবে।
হ্যাঁ সেই ফিরিয়ে দেওয়া সহজ হবে না। তার জন্য সময় লাগবে। রক্ত–ঘাম–কান্না ঝরবে, কিন্তু লক্ষ্যকে ঝাপসা করে ফেললে চলবে না। না ফেললে, এক না এক সময়ে পৃথিবী হাতের মুঠো এসে ধরা দেবেই দেবে। ওই যে ওম শান্তি ওমে শাহরুখ খান বলেছিলেন না, আমরা মন থেকে কিছু চাইলে গোটা মহাবিশ্ব সেটা আমাদের পাইয়ে দিয়েই ছাড়ে.‌.‌.‌ সেরকম। ‘‌এন্ড তক সব ঠিক হি হো যাতা হ্যায়’‌।
কাল যখন শো–র শুরুতে পায়ের সামনে লুটিয়ে পড়া কোনও এক ভক্তকে রূপম বলছিলেন, ‘এসব করিস না।‌ এসব করলে আমিও সেই গুরুই হয়ে যাব, যা আসলে আমি হতে চাই না’‌— তখন মনে হচ্ছিল, আজকের দিনে এর চেয়ে লাগসই মন্তব্য আর হতে পারে না। লোকটা তো কোনও গুরু বা অতিমানব নয়। লোকটা কোনও অলৌকিক মায়াবলে তার হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পায়নি। সে আমজনতার মতো ভুগেছে, কেঁদেছে, লড়েছে। তারপর জিতেছে। তার জয়টা নায়কোচিত হলেও চিত্রনাট্যকারের কলমে সাজানো গল্প নয়। তার জয়টা আমজনতার মধ্যে থেকে উঠে এসে খাস হয়ে ওঠার মধ্যেই।
অনুষ্ঠানের পরে গ্রিনরুমে বিষণ্ন হয়েই বসেছিলেন রূপম। সাউন্ড তাঁর মনোমতো হয়নি। প্রায় প্রতিটি এককের পরেই তাঁকে গিয়ে একবার জড়িয়ে ধরা আমার অভ্যাস। কিন্তু এবার থমকালাম। সরল শিশুর মতো মুখ নিয়ে জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছেন, বাইরের (‌মানে অডিয়েন্স যা শুনছেন)‌ সেই সাউন্ড কেমন ছিল? দেখেশুনে মনে পড়ে যাচ্ছিল নায়ক সিনেমায় সেই দৃশ্য। যেখানে উঠতি নায়ক অরিন্দমকে (‌যে ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন উত্তমকুমার)‌ তাঁর বন্ধু বলছেন, ‘‌এই যে তোর খুঁতখুঁতানি, এটা খুব ভালো সাইন। এর মানে, তুই উন্নতি করবি।’‌ উত্তরে টেবিলে কিল মারতে মারতে উত্তম জবাব দিচ্ছেন, ‘‌আলবাত করব। আই উইল গো টু দ্য টপ, দ্য টপ, দ্য টপ.‌.‌.‌’‌
এই জেদটাই সাধারণকে অসাধারণ করে তোলে। আর এই জেদ আসে আত্মবিশ্বাস থেকে। আত্মবিশ্বাস আসে প্রস্তুতি ও পরিশ্রম থেকে।
জেদ, আত্মবিশ্বাস, পরিশ্রম— স্পার্টার্ন হয়ে ওঠার একেবারে বেসিক ফরমুলা তো এই তিনটেই।
আর এই তিনটে নিয়ে লড়াই করে রূপম যদি পারেন, তাহলে আমি বা আমরা পারব না কেন?‌
রূপম দেখালেন, রূপকথায় বিশ্বাস রাখতে হয়। আজ যা হারিয়েছেন, নিজের কাজে সৎ থাকলে তা ঠিক ফেরত পাওয়া যায়। তবে এই রূপকথা কোনও অতিমানবের রূপকথা নয়। কোনও পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চলে সোনার কাঠি রুপোর কাঠি হাতে নেওয়া রাজপুত্রের রূপকথা নয়। রক্তমাংসের মানুষের রূপকথা।
কালকের একক দেখে ফেরার পরে লোকে যে রূপকথার নাম দিয়েছে রূ’প‘‌ম’‌কথা।

Share this post

Leave a Reply