রেকর্ডিংয়ে বেঁকে বসলেন সুরকার ওপি নায়ার! এ আবার হয় নাকি? তিনি কালজয়ী সঙ্গীত পরিচালক। সুর যখন করেছেন, একটা কিছু ভেবেই তো করেছেন। ওদিকে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে গায়কও অনড়। গোটা লিরিকে আটবার রয়েছে ‘তারিফ করুঁ ক্যা উসকি’ লাইনটি। আটবার আটরকমভাবে এক্সপ্রেশন দিয়ে গাইবেন তিনি।
সুরকার বনাম গায়কের বিতর্কে সরগরম গোটা স্টুডিও। যন্ত্রশিল্পীরা খানিক থতমতো খেয়ে থেমে রয়েছেন। ঝামেলা মেটাতে এগিয়ে এলেন খোদ নায়ক শাম্মি কাপুর। ওপি–কে বোঝালেন, ‘উনি যখন বলছেন, তখন নিশ্চয়ই কিছু ভেবেই বলছেন। দেখাই যাক না। পছন্দ না হলে না হয়...’
শাম্মি কাপুরের অনুরোধে নত হলেন ওপি। গান রেকর্ড হল আটবার আটরকম করে ‘তারিফ করু ক্যা উসকি’ গাইয়েই। রেকর্ডিং শেষে লাফিয়ে উঠে মহম্মদ রফিকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন ওপি। আর গায়কের মুখে তখন স্মিত হাসি।
পরে একটা রিয়েলিটি শো–তে দেখেছিলাম সোনু নিগমকে। একই গানে আটবার একই লাইন আলাদা আলাদা করে গেয়ে বোঝাচ্ছেন, এভাবে গাওয়াটা কতটা কঠিন। আটবারের এক্সপ্রেশন মধ্যে ফারাকগুলো কতটা সূক্ষ্ম, কতটা প্রমিনেন্ট।
রফিই কি বলিউডের ‘এক্সপ্রেশন কিং’? কতরকমের গান গেয়েছেন তিনি? প্রেম–বিরহ–বন্ধুত্ব–ফচকেমি–দেশাত্মবোধক–কাওয়ালি... একবার একটা সমীক্ষা করেছিল একটি সংবাদসংস্থা। বিষয়, রফির গানে কতরকমের এক্সপ্রেশন আছে। ৭৪০৫টি গান গেয়েছিলেন রফি। তাতে এক্সপ্রেশন আছে ৫১৭ রকমের।
গান ছাড়ুন, কোনও নশ্বর রক্তমাংসের মানুষের পক্ষে কি কথা বলার সময়েও ৫১৭টা এক্সপ্রেশন দেওয়া সম্ভব? রফি সেই কাজটাই করেছেন গলা দিয়ে, সুরের একচুল বেচাল না করেই। স্রেফ সুরসাধনায় এ জিনিস হয় না। সা–তে সা আর গা–তে গা লাগিয়ে দেওয়া খুব সহজ। সুর যদি গানের শরীর হয়, এক্সপ্রেশন তার আত্মা। আত্মায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা গভীর নিষ্ঠার সাধনা ছাড়া হয় না। শুধু হারমোনিয়াম, তানপুরায় গলা সেধে সেই সাধনা হয় না।
রফি যখন গান, ‘ইয়ে দেখকে দিল ঝুমা, লি প্যার নে অঙ্গরাই...’ প্রেমিকার প্রতি যে মুগ্ধতা তাঁর কণ্ঠ থেকে টুপটাপ ঝরে পড়ে, তা চোখ বুজে শুনে মনে হয়, এ দুনিয়ায় সব পবিত্র, সব ভালো। কিংবা যখন গেয়ে ওঠেন ‘মুঝে তুমসে মোহাব্বত হো গয়ি হ্যায়, মুঝে পলকো কি ছাঁও মে রেহনে দো’, মনে হয় এ পৃথিবীতে এর চেয়ে নিঃস্বার্থ পবিত্র আত্মসমর্পণ হতে পারে না।
১৯৬৩ সালের ঘটনা। লন্ডনে গাইতে গেছেন রফি। কনসার্ট শেষ করে যখন গ্রিনরুমের দিকে এগোচ্ছেন, উদ্যোক্তারা হাত ধরে ধীরে ধীরে রফির সামনে নিয়ে এলেন এক দৃষ্টিহীন শ্রোতাকে। যে চোখে আলো নেই, সে চোখ থেকে জল ঝরছে। কাঁপাকাঁপা হাতে সেই শ্রোতা রফির হাত দুটো আঁকড়ে বললেন, ‘আমি চোখে দেখতে পাই না, তার জন্য আর কোনও আক্ষেপ নেই। আপনার সুর এবং অভিব্যক্তি আমার চোখের সামনে পৃথিবীর সব রং দেখিয়ে দিয়েছে।’
বলিউডে নিখুঁত সুরে গাইতে পারেন, এমন গায়ক কি কম এসেছেন? তাহলে কেন রফি আজও স্মরণীয়? কী করে এমন এক্সপ্রেশন দিতে পারেন কেউ? আমার মতো কট্টর কিশোরকুমারভক্তের মনও কোন ম্যাজিকে দ্রব করে ফেলেন রফি? নিখুঁত সুরসাধনা? শুধু তাই নয়। রফির জীবনী যখন পড়ি, তখন জানতে পারি শুধু কান কিংবা কণ্ঠ দিয়ে এই ইন্দ্রজাল তৈরি করা সম্ভব নয়। আপনার হৃদয় যদি নিষ্কলুষ পবিত্র না হয়, তাহলে এ জিনিস গলা থেকে বেরতে পারে না। মানুষ হিসেবে রফি অজাতশত্রু তো বটেই, তার পাশাপাশি এমন কিছু কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলতেন মাঝেমাধ্যে, যা বিরাট মনের মানুষ না করা সম্ভব নয়।
আবেগ, আবেগ! আসল কথাটা হল আবেগ। তুলোর মতো নরম মনের মানুষ রফির মনটা এমন আবেগে ভরা ছিল, যা তাঁকে অমন ভুবনমোহিনী আবেগে গাইয়ে নিত। কেমন ছিল সেই আবেগ? রফির কন্যা নাসরিন আহমেদ একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, মুম্বইয়ে একবার প্রচণ্ড গরমে রাস্তা ভয়ানক তেতে ছিল। রফি রাস্তা দিয়ে গাড়িতে চড়ে যেতে যেতে দেখতে পান, পিচগলা রাস্তা এমনই গরম যে, একজন সাধারণ পথচারী লোক কোনও রকমে এক পা তুলে অন্য পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াচ্ছেন! এভাবেই হাঁটছেন। খানিকক্ষণ দৃশ্যটা দেখে রফি নিজে জুতোজোড়া খুলে হাতে করে ওই ব্যক্তির কাছে গিয়ে অনুরোধ করেন, জুতোজোড়া পরে নেওয়ার জন্য। আচমকা চোখের সামনে মহম্মদ রফি! ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থমকে গিয়েছিলেন পথচারী। সম্বিত ফিরতেই রফির জুতোজোড়া হাতে মাথায় ঠেকিয়ে নিয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছিলেন ওই ব্যক্তি। রফি যে তাঁর প্রিয় গায়ক! ওদিকে খালি পায়ে বাড়ি ফিরেছিলেন রফি। প্রয়াত কিংবদন্তীর পুত্রবধূ ইয়াসমিন খালিদ ২০২০ সালে রফির একটি জীবনী লেখেন, যার নাম ‘মোহাম্মদ রফি: মাই আব্বা’। বইটা খানিক পড়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে ইয়াসমিন এ–ও লিখেছিলেন, কোনও এক জেলে নাকি কোনও এক ফাঁসির আসামী মৃত্যুর আগে শেষ ইচ্ছে হিসেবে নাকি রফির গান শুনতে চেয়েছিলেন টেপরেকর্ডারে।
আবার, প্রতিবেশী সহায়সম্বলহীন বিধবাকে বেনামে টাকা পাঠাতেন রফি৷ রফির মৃত্যুর পর টাকা পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়৷ এরপর সেই বিধবা মহিলা পোস্ট অফিসে গিয়ে খোঁজ নেন ৷ তখন তিনি জানতে পারেন, যে মানি অর্ডার তাঁকে কে পাঠাতেন! জানার পর রফির মেয়ে–জামাইয়ের সঙ্গে দেখা করে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে এসেছিলেন ওই মহিলা।
আবেগ এবং এক্সপ্রেশনের গানের ক্ষেত্রে কতটা গুরুত্বপূর্ণ? আর দুই গায়কের উদাহরণ দিয়ে বলি। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য বাংলা গানের এক দিকপাল। তাঁর ভাই পান্নালাল ভট্টাচার্যের শ্যামাসঙ্গীত ছাড়া বাঙালির কালীপুজো সম্পূর্ণ হয় না। ধনঞ্জয়ের মতো কিংবদন্তি অবধি বলেছেন, ‘পান্নার মতো নাড়িছেঁড়া মা-ডাক ডাকতে পারলাম কই!’ গানে ওই নাড়িছেঁড়া আবেগই রফির মতো কিংবদন্তিকে অমর করে রাখে। বয়স যতই বাড়ুক, রফির কণ্ঠে একটা টিনএজার প্রেমিকের মতো আবেগ ছিল আমরণ। ওই আবেগকে উপেক্ষা করা কোনও রক্তমাংসের মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
আরাধনা হিট হওয়ার পর থেকে কিশোরকুমারের উত্থান ঘটে উল্কাগতিতে। অভিমানী রফি নাকি ঘনিষ্ঠমহলে বলেছিলেন, ‘আমি কি আর গাইতে পারছি না?’ যদিও কিশোরের প্রতি বিন্দুমাত্র অসূয়া ছিল না তাঁর। সাময়িক বিরতি নিয়ে তীর্থযাত্রায় চলে যান। ফেরেন, ‘ক্যা হুয়া তেরা ওয়াদা’ অথবা ‘দর্দ–এ দিল দর্দ–এ জিগর’–এর মতো মেগাহিট গান নিয়ে। কিশোরেরও অটল শ্রদ্ধা ছিল রফির প্রতি। বহুক্ষেত্রেই এরকম হয়েছে, গানের সুর শুনে কিশোর পরিচালকদের সাফ বলে দিয়েছেন, ‘এ গান রফি সাহাব ছাড়া কারও পক্ষে সম্ভবই নয়।’ আবার এই কিশোরই রফির মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহ আঁকড়ে শিশুর মতো হাউহাউ করে কেঁদেছেন।
রফি না কিশোর? এ প্রশ্নে বেশিরভাগ বাঙালির ভোটই কিশোরের দিকে। আমিও সেই দলেই। কিশোর আমার কাছে ঈশ্বর, আমার ধর্ম। তবু রফিকে আমি দেখি আমার ধর্মের অবতার হিসাবে। যিনি আমার কাছে ঈশ্বরের চেয়ে কোনও অংশে কম নন।
শেষ করি একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে। তখন আমি কাঠবেকার। মাচায় খেপ বাজাই। মানে, ওই পাড়ায় পাড়ায় কালীপুজো, দশমীতে যে চটুল গানের জলসাগুলো হয়, সেখানে কিশোরকণ্ঠী, হেমন্তকণ্ঠীদের সঙ্গে। টুকটাপ পকেটমানি জুটে যায়। তেমনই এক অনুষ্ঠানে সোদপুরে একটি পাড়ার জলসায় আলাপ হয়েছিল এক রফিকণ্ঠীর সঙ্গে। আমাদের আগে তাঁর স্টেজ। এসব ক্ষেত্রে গ্রিনরুমের বালাই থাকে না। স্টেজের পাশের ক্লাবঘরে শিল্পীদের ঠাঁই হয়। আমরা স্টেজে উঠব, চা–টা খাচ্ছি। এমন সময় অনুষ্ঠান সেরে রফিকণ্ঠী ভদ্রলোক নেমে এলেন। সুটকেস খুলতেই দেখলাম ভিতরে রফির ছবি। ছবির সামনে হাঁটুগেড়ে বসে কান্নাছলছল চোখে নিজের কান মুলছেন আর বলছেন, ‘আর কোনও দিন হবে না, কখনও হবে না।’ যেন সাক্ষাৎ রফি তাঁর সামনে বসে রয়েছেন। আর তিনি রফির কাছে ক্ষমা চাইছেন!
কৌতূহল হল। ভদ্রলোক একটু সামলে ওঠার পরে জিজ্ঞাসা করলাম, কী হয়েছে? ভদ্রলোক যা বললেন, তা হল, ‘ম্যায়নে পুঁছা চান্দ সে’ গানটি গাওয়ার সময় কোরাস লাইনটি অর্থাৎ ‘নহি নহি নহি’ গাওয়ার সময় দু’বার তিনি বেসুরো গেয়ে ফেলেছেন। এসব অনুষ্ঠানে সাধারণত উন্নত মনিটর থাকত না সেই সময় (২০০৫–২০০৬) সালের কথা বলছি। রফি তাঁর কাছে ঈশ্বর, রফির গান তাঁর কাছে পুজোর মতো। পুজোয় ভুল হলে চলে!
কট্টর কিশোরভক্ত তবু কেমন যেন গলে গেলাম। বললাম, ‘ঠিক আছে দাদা, এসব হয়।’ উত্তরে ভদ্রলোক বলেছিলাম, ‘আমি বিশ্বাস করি, আমার প্রতিটি অনুষ্ঠানে রফি সাহাব পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। উনি শুনেছেন, কতটা কষ্ট পেয়েছেন বলুন তো।’
কে বলেছে, মহম্মদ রফি প্রয়াত হয়েছেন।
জন্মশতবার্ষিকীতে ওঁকে শ্রদ্ধা, শ্রদ্ধা এক কট্টর কিশোরভক্তের পক্ষ থেকে