You are currently viewing সোনু ‘‌প্রেত’‌ নিগমকে খোলা চিঠি

সোনু ‘‌প্রেত’‌ নিগমকে খোলা চিঠি

Share this post

এই যে শ্রীযুক্ত সোনু ‘‌প্রেত’‌ নিগম,
পা দুটো এদিকে বাড়িয়ে দিন তো। একটু হাত বুলিয়ে ছুঁয়ে দেখি আপনাকে। আপনি কি রক্তমাংসের মানুষ আদৌ?‌ কোনও মানুষের পক্ষে এমন গাওয়া সম্ভব?‌ নাকি জন্মরাশিতে এমন কোনও অলৌকিক যোগ নিয়ে জন্মেছেন, যার ফলে যা আর কেউ পারে না, তা আপনি পারেন!‌
ভুলভুলাইয়া থ্রি অতি খাজা, অতি অখাদ্য একটি সিনেমা। শেষের ১৫ মিনিট বাদে কোথাও কিস্যু নেই। এমনকী, এই আমার এত প্রিয় বিদ্যা বালন, তাঁকে দেখার জন্যই তো সিনেমাটা দেখতে বসা, সেই বিদ্যার রোলটা অবধি বিরক্তিকর লাগছিল। নড়েচড়ে বসলাম, সোনুর গলায় ‘মেরে ঢোলনা’ শুনে।
আমি বিশ্বাস করি, ‘‌মেরে ঢোলনা’‌ শ্রেয়া ঘোষালের চেয়ে ভাল কেউ গাইতে পারেন না। শ্রেয়া যখন গান, সাক্ষাৎ সরস্বতী মানবীর রূপ ধরে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ান। সে জিনিস ঐশ্বরিক। সোনু কি ‘‌মেরে ঢোলনা’‌ শ্রেয়ার চেয়ে ভাল গেয়েছেন?‌ এ তুলনা অর্থহীন। কারণ, সোনু যেটা গেয়েছেন, সেটা মেরে ঢোলনা হলেও আলাদা গান। গানের কয়েকটা লাইনে লিরিক এবং সুরের মিল থাকলেই, তা এক গান বলা চলে না। কেন বলা চলে না, তার সবচেয়ে বড় কারণ হল, গানের ইমোশন।
শ্রেয়ার ‘‌মেরে ঢোলনা’ প্রেমের ও বিরহের গান। আর সোনুর ‘‌মেরে ঢোলনা’‌?‌ চার-চারটে ইমোশন দিয়ে গানটা গড়া। প্রেম, আতঙ্ক, হৃদয়ভঙ্গ এবং প্রতিশোধপরায়ণতা। সোনু যখন গেয়েছেন, এক–একটা ইমোশন চোখের সামনে যেন দেখা গেছে— এতটাই স্পষ্ট।
গান যখন শুরু হচ্ছে, সোনু সেখানেও আলাদা। শ্রেয়া বা অরিজিতের ভার্সনের শুরুর ‘‌মেরে ঢোলনা’–র উচ্চারণ বা গায়কী‌ অনেক বেশি উচ্চকিত, অনেক চঞ্চল। আর সোনুর?‌ ‘‌মেরে ঢোলনা’–র উচ্চারণ বিষাদব্যথায় ভারী। খেয়াল রাখতে হবে, ভারী গলায় গাওয়া কিন্তু সোনুর ট্রেডমার্ক নয়। বরং তিনি পাতলা স্বরেই গাইতে পছন্দ করেন। কিন্তু সোনু গাইলেন ভারী গলায়। কেন?‌ না, যে ক্যারেক্টারের গলায় তাঁকে গাওয়ানো হচ্ছে, সেই চরিত্র বিষণ্ণ, আশাহত, বিশ্বাসঘাতকতার শিকার। সোনু যেন ক্যামেরার সামনে না এসেও স্রেফ কণ্ঠ দিয়েই অভিনয় করে যাচ্ছেন।
সোনু যখন গাইছেন, ‘‌মেরি নফরতে তো ফিজা মে বহেঙ্গি’.‌.‌.‌ ‘‌নফরত’–এর যে উচ্চারণটা সুর ধরে রেখেই সোনু করেছেন— ঘৃণায় আপনার শরীর রি–রি করে উঠতে বাধ্য। সোনু যখন গাইছেন, ‘‌মেরে ঢোলনা সুন, মেরে দর্দ–কে ধুন’‌, তখন সত্যিই আপনি যার মুখ দিয়ে এই গান গাওয়ানো হচ্ছে, তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাবেন সমব্যথ্যায়।
একটা সময়ে মনে হবে, সমীরের লেখা এই গানের লিরিক যেন আর পাতার কয়েকটা শব্দ নয়। যেন চোখের সামনে উঠে দাঁড়িয়ে হাহাকার করছে। নাচছে। ‌‌
অ্যালবাম মিউজিক আর প্লে–ব্যাকের মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকে। প্লে–ব্যাকে গাইতে হয় চিত্রনাট্য বা ঘটনাপ্রবাহ যেমন দাবি রাখবে, সেই দাবি মেনে। সঙ্গীত পরিচালক তো বটেই, সেখানে প্লে–ব্যাক সিঙ্গার কিয়দংশে ডিরেক্টরেরও হাতের পুতুল। তার মধ্যেই মিউজিক ডিরেক্টর ও সিনেমার ডিরেক্টরের দাবি মিটিয়ে কেউ কেউ নিজস্ব সিগনেচার রেখে যান।
ভুলভুলাইয়া থ্রি পয়েন্ট জিরো–তে আপনি যেটা করেছেন, সেটা স্রেফ আলগোছে স্বাক্ষর নয়, ওটাকে ছেনিহাতুড়ি দিয়ে ঠুকে সগর্বে চিরস্থায়ী শিলালিপি লিখে যাওয়া বলে। যে শিলালিপি চিৎকার করে বলছে, যে যার মতো গেয়ে নিক। সোনু যখন কানে হেডফোনটি গুঁজে মাইকের সামনে গাইতে দাঁড়ান, তখন গোটা ইন্ডাস্ট্রির উচিত, ঠোঁটের ওপরে আঙুল রেখে চুপটি করে শোনা। কারণ, প্লেব্যাক করা মানে স্রেফ সা–তে সা আর রে–তে রে লাগিয়ে গেয়ে দেওয়া নয়। তার প্রতিটি নোটে গোটা সিনেমার নাটকীয়তার গল্প বলার একটা দায় থাকে। সোনু সেই দায়টাকে দায়িত্ব করে কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
গানের একটা সরগম আছে পুরিয়া ধনশ্রী রাগে। শুনুন, বুঝবেন সোনু নিগম কেন লেজেন্ড।
খুব কৌতূহল হচ্ছিল, সিনেমার প্রোমোশনে কেন গানটার কথা বলা হচ্ছিল না। বরং বেশি করে বলা হচ্ছিল শ্রেয়া ঘোষালের ভার্সনটার কথা। সেটা পরিষ্কার হল সিনেমাটা দেখার পরে। কারণ, গানটার প্রোমোশন করলে সিনেমার আসল টুইস্টটাই বেরিয়ে যেত। কারণ, এই গানে পুরো সিনেমার গল্পটাই বলে দেওয়া হয়েছে। সোনু শ্রেয়া ঘোষাল তো বটেই, ইন্ডাস্ট্রিরও সবচেয়ে সিনিয়র শিল্পীদের একজন। কোথাও এ নিয়ে বিন্দুমাত্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বলে শুনিনি। তারপরেও একটা ইভেন্টে মঞ্চে যখন আরিয়ান কার্তিক এবং সোনু রয়েছেন, ছেলেপুলে হামলে পড়ছে কার্তিকের সঙ্গে সেলফি তুলবে বলে, সোনু একপাশে সরে যাচ্ছেন হাসিমুখে।
সোনু নিগম আসলে এক অশরীরী প্রেত। যাঁকে দেখা যায় না, শোনা যায়।
সিনেমার প্রোমোশনে তিনি বা তার গানের কোনও প্রসঙ্গ নেই।
ইভেন্টের মঞ্চে তাঁকে দেখেও ‘‌অনদেখা’‌ করে দেওয়া হয়।
তাঁর এমন লেজেন্ডারি পারফরমেন্স, যা কোনও রক্তমাংসের মানুষের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয় ।
তবু, তিনি যখন ‘‌মেরে নফরতে’‌ গেয়ে ওঠেন, ওই ‘‌নফরতে’‌ উচ্চারণটা শুনে গায়ে কাঁটা দিতে বাধ্য।
প্রেতের কাজই তো গায়ে কাঁটা দেওয়ানো।


Share this post

Leave a Reply