ঋত্বিকদা,
আমাকে তোমার মনে থাকার কথা নয়। সম্ভবত নেইও। ঘনিষ্ঠতারহিত মানুষদের, বিশেষত তারকাদের, ‘তুমি’ ও ‘দাদা’ বলে ডেকে ফেলার যে রেওয়াজ, তাতে আমার বিশেষ সায় নেই। তবু ডাকলাম এক বিশেষ অধিকারবোধ থেকে। কারণ, ২০১৬ সালে তিনদিনের আলাপ ও উথালপাথাল আড্ডায় আমাদের সম্বোধন তোমার ও আমার দিক থেকে যথাক্রমে ‘তুই’ ও ‘তুমি’–তে নেমে এসেছিল। সেটুকু জিইয়ে থাকুক।
ফিল্মবোদ্ধা বলতে যা বোঝায়, তা যে আমি নই, সে কথা শুরুতেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো। তবু আমাকে যদি কেউ যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে সমকালীন টলিউডে আমার প্রিয়তম অভিনেতা কে, বন্দুকের ছররার মতো আমার মুখ থেকে একটাই বিশেষ্য বেরিয়ে আসবে— ঋত্বিক চক্রবর্তী। সেটা আজ থেকে নয়, ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’–এর সময় থেকে।
আমার প্রাক্তনের এক প্রাক্তনের অনুরোধে এই অধম একটি ফিল্মের চিত্রনাট্য ও সংলাপ লেখার ডাক পেয়েছিল। তখনও সে ফিল্মের নাম চূড়ান্ত হয়নি, কেন্দ্রীয় চরিত্র তো দূরের কথা। লিখতে লিখতেই ফিল্মের নাম ঠিক হলো ‘বুড়ো সাধু’, যে ফিল্মের স্টিল ছবি আজও তোমার উইকিপিডিয়ার ফিচার ফটো। এক মধ্যবিত্ত যুবকের কিচ্ছু না থেকে নামী সিনেমা পরিচালক হয়ে ওঠার গল্প। তার মধ্যে টুইস্ট আছে, খানিক উত্থান–পতনও আছে।
শুনেছি বড় বড় পরিচালকরা আজকাল আগে থেকে নায়ক ঠিক করে নিয়ে তারপর গপ্প ফাঁদেন। এক্ষেত্রে ব্যাপারটা সেরকম ছিল না। গল্প যতই এগোতে লাগল, ততই তার মধ্যে আমি আমার ইনপুট গুঁজতে থাকলাম। পৌনে ভাগ যখন শেষ হয়েছে, তখনও নায়ক চরিত্রে কাকে নেওয়া হবে, চূড়ান্ত করা যায়নি। ভোটাভুটি চলল দু’জনের মধ্যে অনির্বাণ এবং তুমি।
অনির্বাণ তখনও ‘দ্য অনির্বাণ ভট্টাচার্য’ হয়ে ওঠেননি। তখন দার্জিলিং থেকে মেদিনীপুর কিংবা বীরভূম থেকে নদিয়ার তরুণীরা তাঁকে দেখলে একটা হার্টবিট স্কিপ করেন না। অন্যদিকে তুমি টলিউডে বেশ প্রতিষ্ঠিত। তোমার প্রতি, তোমার অনাবশ্যক বাহুল্যহীন অভিনয়ের প্রতি আমার একটা চরম দুর্বলতা রয়েছে। ফলত, নায়ক কে হবেন, এই প্রশ্নে আমার ভোট গেল তোমার দিকেই। এই পক্ষপাত সম্ভবত আমার লেখার ক্ষেত্রেও ছাপ ফেলেছিল। লেখা যখন শেষ হলো, স্ক্রিপ্ট পড়তে পড়তে সকলেই মোটামুটি একমত হলেন, হ্যাঁ এই চরিত্রের অ্যাটিটিউড খানিক বদলেছে বটে, তবে বদলানোর পরে যা দাঁড়িয়েছে, তাতে ঋত্বিক চক্রবর্তী ছাড়া আর কাউকে এই চরিত্রে ভাবা যাচ্ছে না।
‘বাকিটা ব্যক্তিগত’ কি আমার লেখায় খানিক বেশিই প্রভাব ফেলেছিল? হতে পারে, কারণ ওই ফিল্মে নায়কের নিকটতম বন্ধু বাঞ্ছার চরিত্রটাও এমন দাঁড়িয়েছিল যে সেই চরিত্রে অমিত সাহা ছাড়া কাউকে ভাবা যায়নি। আমার লেখা চিত্রনাট্য সংলাপে ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’–র ঋত্বিক–অমিত জুটি ফিরে এলো, এটা ভাবতেও ভালো লাগছিল।
খানিক বিজ্ঞাপনের মতো শোনাচ্ছে কি? শোনাক। আজকের দিনে বোধহয় এরকম দু’–চার কথার গায়ে যে আত্মপ্রচারের গন্ধ লেগে থাকে, তাকে উপেক্ষা করা যায়। মনে মনে যখন ঠিকই করে নিয়েছি, এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে ঋত্বিক চক্রবর্তীকেই দেখা যাবে, তখন চুপিচুপি রিসার্চ শুরু করে দিয়েছি রিসার্চ। আমার প্রিয় অভিনেতার মুখের সংলাপ বেরবে আমার কলম থেকে! আমাকে তো বুঝতে হবে, কোন কোন বর্ণ এবং কী ধরনের বাক্য তোমার মুখে ভালো লাগে। চিত্রনাট্যের চাহিদা মেনেই সেগুলো বেশি করে গুঁজতে হবে তোমার সংলাপে।
অনির্বাণ না ঋত্বিক? ব্যাপারটা তখনও অফিসিয়ালি চূড়ান্ত হয়নি। যদিও আমি মনে মনে জানি, ঋত্বিকই। তবু একটা ব্যালেন্স রেখে তো চলতে হবে। অনির্বাণের মুখে যেমন সবচেয়ে বেশি শুনতে ভালো লাগে বাংলা ভাষার তিনটে স (স,শ,ষ)। শুনতে ভালো লাগে স্টেটমেন্ট ধরনের বাক্য। তেমনই সাধারণ দর্শক হিসেবে তেমনই আমার তোমার মুখে শুনতে ভালো লাগে ক বর্গের বর্ণগুলো। শুনতে ভালো লাগে প্রশ্ন, বিস্ময় এবং বিরক্তিসূচক বাক্য। মনে হয়, ঋত্বিক নামক কোহিনুরটির আলো আরও বেশি ঝলমলিয়ে ওঠে এই ধরনের বাক্যে, এই এই বর্ণের উচ্চারণে। মিথ্যে বলব না, তুমুল খেটেছিলাম বেছে বেছে বেশি করে এই ধরনের বাক্য ও বর্ণ সংলাপে ঢোকাতে। আজও যদি কেউ ফিল্মটা দেখেন (অ্যামাজন প্রাইমে পাওয়া যায়), খেয়াল করতে পারবেন বেছে বেছে কতবেশি ‘ক’ ঢোকানো রয়েছে ঋত্বিকের সংলাপে। ঋত্বিক আমার লেখা সংলাপে ক্যামেরার সামনে দাপাবেন, তাঁর অভিনয়ের আরও সুন্দর হয়ে উঠবে, লেখার সময় এই শ্লাঘা মনের মধ্যে বুজকুড়ির মতো ফেনা কেটে বেড়াত অহর্নিশ।
এরপর শুরু হলো শ্যুটিং। বুঝলাম আমার অবজারভেশন মিথ্যে নেয়। কী অবলীলায় ক্যামেরার সামনে সংলাপ বলে যাও তুমি। অভিনয় করো গোটা শরীর দিয়ে। ক্যামেরা যতক্ষণ চলে ততক্ষণ লাইট ক্যামেরা মেকআপ সব মিথ্যে। সত্যি শুধু আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা। সে স্টার নয়। বরং আমি যেমন লিখেছি, সে ওই মধ্যবিত্ত ফিল্মমেকার হতে চাওয়া ছেলেটাই।
জানি না মনে আছে কি না, তবু একবার প্রসঙ্গটা তুলি। মনে আছে, ফিল্মে একটা দৃশ্য ছিল, কলেজের প্রেমিকার (মিশমি দাস) করেছিলেন চরিত্রটা) কাছে অপদস্থ হওয়ার পর আবীর (যার চরিত্রটা তুমি করেছিলে) নদীর ঘাটের পাশে বসে নেশা করছে। হাতে মদের বোতল। দৃশ্যটা ছিল এরকম— বোতল ধরে চুমুক দিতে দিতে প্রেমিকার অপমানের কথা মনে করে নিজেরই ওপরে হাহা করে হাসছো তুমি। হাসতে হাসতেই মুহূর্তে অট্টহাসি রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে বুক ভাঙা কান্নায়। একটাই শট। ক্লোজ আপ শট। মাঝে যে ব্রেক নিয়ে চোখে গ্লিসারিন দেওয়া হবে সে উপায় নেই। সেই শটের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত পিছনে বসে হাসিঠাট্টা করছিলে তুমি। শট রেডি হতেই গটগটিয়ে উঠে হেঁটে গেলে। ‘অ্যাকশন’ বলা মাত্রা পা টলোমলো হয়ে গেল। চোখ হয়ে এল ছোট। অবশ পায়ে ধপ করে বসে পড়লে মাটিতে। মুখে হাসির পর বিদ্যুতের গতিতে চোখে এল কান্না। গ্লিসারিনবিহীন চোখ থেকেই টপটপ করে নামতে শুরু করল জলের ধারা!
খেয়াল করেছিলে কি না জানি না, গোটা ইউনিট সে সময় চুপ। আউটডোর তবু যেন বালিতে সুচ পড়লে তার আওয়াজ পাওয়া যাবে এমন নৈশব্দ্য! এমন অসাধারণ দৃশ্যের অর্ধেকটা (কান্নার অংশটুকু) রাখা হয়েছিল ফিল্মে। হাসি থেকে কান্নায় রূপান্তরিত হওয়ার ওই যে অলৌকিক মুহূর্তটা সেটা শুধু রয়ে গেল আমার মাথায়। একদিক থেকে ভালো, ওটা আমার ‘এক্সক্লুসিভ স্মৃতি’ হয়েই থেকে যাবে।
কমার্সিয়ালে দেব না জিৎ, শহুরে সিনেমায় অনির্বাণ না পরমব্রত— এসব বিতর্কে আমি যাই না। কারও দক্ষতাকে ছোট না করেই বলতে পারি কারণ সমকালীন বাংলা ছবিতে আমার প্রিয়তম অভিনেতা তুমি। তার কারণ, বাকিরা Acting করে। আর ক্যামেরার সামনে তুমি যেটা করো, সেটা রিয়্যাকশন। স্ক্রিপ্ট এবং পরিচালক তোমাকে যে পরিস্থিতিটা বলে দেয় তুমি সেই অনুযায়ী রিয়্যাক্ট করো। আমাদের দেশে লোক অ্যাক্টিং বললেই তার মধ্যে গ্যাদগ্যাদে ম্যানারিজম ঢুকিয়ে দেয়। যতবড় স্টারই হন না কেন, হাতে গোনা কয়েকটা ক্ষেত্র ছাড়া তিনি নিজস্ব ম্যানারিজম ঢোকাবেনই ঢোকাবেন। তোমার মধ্যে ওই অনাবশ্যক ম্যানারিজমটা পাই না বলেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে, এই লোকটা যা করছে ক্যামেরার সামনে, সেটা অভিনয় নয়। সত্যি।
ঠিক সেই কারণেই বন্ধুবৃত্তে সমকালীন বাংলা সিনেমা এবং অভিনেতাদের নিয়ে যখন তর্কবিতর্ক হয়, ‘ঋত্বিক সুপ্রিমেসি’ প্রমাণের জন্য একটি বাক্য বলে আমি তাতে জল ঢেলে দিই, সেটা হলো, ‘অন্যরা act করেন, ঋত্বিক react করেন’।
এই অ্যাক্ট ও রিয়্যাক্টের মধ্যে ফারাক কতটা? আরও একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাই। ‘বুড়ো সাধু’ কম বাজেটের ফিল্ম ছিল। সেখানে আমাকে গিটার বাজাতে জানা একজন এক্সট্রার ভূমিকায় অভিনয়ও করতে হয়েছিল। দৃশ্যটা ছিল এরকম। তোমার চরিত্রটি তখনও নামজাদা পরিচালক হয়ে ওঠেনি। সবে টুকটাক মেগাসিরিয়ালের শ্যুটিং সামলানোর দায়িত্ব পেয়েছে। সে শ্যুটিং ফ্লোর ঘুরেঘুরে সব তদারক করছে। এরই মধ্যে আমি দু’জন এক্সট্রার সঙ্গে বসে গিটারে টুংটাং করছি। তুমি ঘরে ঢুকবে, খানিক ভাবগম্ভীর গলায় বলবে, ‘ভাই এখানে শব্দ করো না।’ যেহেতু তুমি নতুন, আমি তোমাকে পাত্তা দেবো না। মুখ বেঁকিয়ে অবজ্ঞা করে বাজাতেই থাকব।
কার্যক্ষেত্রে কী হলো? তুমি ঘরে ঢুকলে, ‘ভাই এখানে শব্দ করো না’ বললে। কিন্তু এমনভাবেই বললে যে আমারই লেখা স্ক্রিপ্টে আমিই ভেবলে গেলাম। বাজানো বন্ধ করে দিলাম।
পরে পরিচালক বলেছিলেন, ‘এটা এভাবেই থাকুক। চরিত্রটার দাপট এস্ট্যাবলিশ হবে এতে। এটাই ভালো লাগছে।’
অ্যাক্ট আর রিয়্যাক্টের ফারাক এতটাই। আনন্দবাজারকে দেওয়া একটা সাক্ষাৎকারে তুমি বলেছিলে, ‘জীবনের সঙ্গে ভান চলে না, যে জীবন স্বচ্ছন্দ, সেটাই বাঁচতে চাই’। ঠিক সেটাই তো তুমি ক্যামেরার সামনেও করো। ক্যামেরার সামনে ভানহীন যাপন। সেটা অভিনয় বললে অভিনয়, বাঁচা বললে বাঁচা। ঠিক সেই কারণেই তোমার অভিনয় আর অভিনয় বলে মনেই হয় না। স্বাভাবিক সাবলীল যাপন হয়ে যায়, যাকে আমি এতক্ষণ ধরে ‘রিয়্যাক্ট’ করা বলে আসছি।
ঠিক সেই কারণেই তোমার ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’–র থুতনিতে হাত বোলানো, তোমার ‘এবার শবর’–এর চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে অস্থির অপেক্ষায় পা দোলানো, তোমার ‘নির্বাক’–এর মর্গের দৃশ্যে সুস্মিতা সেনের পাশে শুয়ে বোকাবোকা তৃপ্তির হাসি, তোমার শব্দের ভুরু কুঁচকে তাকানো— বিশ্বাস করো, কোনওটাই অভিনয় বলে মনেই হয় না।
আমরা কাজ কেন করি? শুধুই অর্থোপার্জন? মোটেও না। আমাদের প্রতিটি পেশাদার কাজ অর্থের পাশাপাশি মনে রাখার মতো, আজীবন লালন করে যেতে পারার মতো কিছু না কিছু স্মৃতি দিয়ে যায়। আমি ঝানু স্ক্রিপ্ট–ডায়লগ রাইটার নই। গল্প বলার খানিক অভ্যাস (‘ক্ষমতা’ লিখেও ব্যাকস্পেস মারলাম। ওটা লেখা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে) আমার রয়েছে। সেটার দৌলতেই আমার প্রিয় অভিনেতার জন্য দু’কলম লিখে ফেলার সুযোগ এসেছিল আজ থেকে আট বছর আগে— এটুকুই আমার জন্য যথেষ্ট। আর কোনওদিন কারও জন্য কিচ্ছু না লিখলেও কিস্যু যাবে আসবে না।
কোলাকুলিটা বাকি থেকে গেছে। আমি নিশ্চিত, তা একদিন হবে। হবেই।
শুভ জন্মদিন ঋত্বিকদা। ভালো থেকো। আর অভিনয় দরকার নেই, স্রেফ রিয়্যাক্ট করতে থেকো।
ওটাই ভানহীন জীবন, ভানহীন যাপন।