You are currently viewing মন্ত্রিত্ব লাগে না, মদন এমনিই ‘‌কালারফুল বয়’‌

মন্ত্রিত্ব লাগে না, মদন এমনিই ‘‌কালারফুল বয়’‌

Share this post

কারাবাসের মেয়াদ কাটিয়ে মদন মিত্র তখন সবে ফিরেছেন। ঘরেও, জনমানসেও। রাতের দিকে সোনালি সানগ্লাস চোখে এঁটে দু’‌–চারটে যা লাইভ করেছেন, তার থেকেই ‘সলমন ফিশ’‌, ‘‌গালাগালি দিলে আমি কিন্তু চলে যাব’‌, ‘ওহো ফাটাফাটি’‌— নেটদুনিয়ায় সুপারহট কন্টেন্ট। ‘‌পাঁচ মিনিটে লাইভে আসছি’‌ লেখা টি–শার্ট চোখে পড়ছে ছেলেছোকরাদের মধ্যে। ফেসবুকে মিম তৈরি হচ্ছে, কার প্রত্যাবর্তন বাঙালির মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাড়া ফেলেছে— সৌরভ, ভাওয়ালের সন্ন্যাসী রাজা নাকি মদন মিত্র?‌
এমন এক সময়ে শ্রীযুক্ত মদন মিত্রের দক্ষিণেশ্বরের ফ্ল্যাটে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেল। সাক্ষাতের সময় ছিল দুপুর দুটো। ‘‌কী ব্যাপার, কাকে চাই’‌–এর পর্ব মিটিয়ে শুনলাম ‘একটু বসুন, দাদা আসছে’‌। সন্ধে সাড়ে ছ’‌টা নাগাদ তিনি এলেন। এসেই প্রথম যে কথাটা বললেন, তাতে পায়ের তলার মাটি সরে যাওয়ার জোগার। এমার্জেন্সি একটা কাজ পড়ে গেছে। আজ ইন্টারভিউ হবে না। ইন্টারভিউ যে ছিল, সেটা তাঁর মাথায় আছে। কিন্তু এমন একটা কাজ, যেটা এড়ানো যাবে না।
সহকারী সাংবাদিক (‌যিনি ইন্টারভিউটা নেবেন)‌ এবং চিত্রসাংবাদিক আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন, আমি তাকাচ্ছি তাঁদের মুখের দিকে। এত দূর থেকে এত কষ্ট করে এসে তরীটা তীরেই ডুববে?‌
হঠাৎ ফস করে কী মনে হল, তিনি বললেন, ‘‌গাড়িতে যেতে যেতে ইন্টারভিউটা করে নিতে পারবেন?‌ তাহলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। আপনার কাজও হবে, আমার কাজটাও আটকাবে না।’‌ যে কোনও সাংবাদিকের কাছে ঘরে বসে ইন্টারভিউয়ের থেকে গাড়িতে ইন্টারভিউ নেওয়াটা একটু প্রেস্টিজিয়াস। গাড়ির মধ্যে ইন্টারভিউতে সংশ্লিষ্ট নেতা কিংবা তারকার সঙ্গে যেন একটা ব্যাক্তিগত মাখোমাখো সম্পর্ক রয়েছে এমনটা প্রিটেন্ড করা যায়, অন্তত অনেকেই করেন। লাফিয়ে এই প্রস্তাব লুফে নেওয়া মাত্রই হুকুম উড়ে গেল— ‘‌গাড়ি বের করতে বল। ওই গাড়িটা।’‌
গাড়ির মডেল আমি ভীষণরকম কম চিনি, তাই নাম বলতে পারব না। তবে ‘‌ওই গাড়িটা’‌ রীতিমতো ঝাঁ চকচকে, বেশ ‘‌মদনোচিত’‌। মানে গাড়ি কম, প্রমোদকক্ষ বেশি। ‌মদন মিত্রের ইমেজের সঙ্গে লাগসই বটে!‌ অনেকটা থার টাইপের দেখতে। ভিতরে লাল নীল আলো। দরজা খুলে ভিতরে বসতে গেলেই তীব্র সুগন্ধী নাকে এসে ঝাপটা মারে। ঈষৎ পৃথুল চেহারাটা নিয়ে খানিক হাঁচরপাচর করে ফ্রন্ট সিটে বসতে বসতে তিনি বললেন, ‘‌খুশি তো?‌ মদন মিত্র দেরিতে হলেও কথা রাখে।’
তখন সামনেই ২০১৯ লোকসভা নির্বাচন। মমতার গলায় ‘‌বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশের’‌ দাবি শোনা যাচ্ছে। মমতার দাবি মদনের গলায় গর্জন হয়ে ফিরে এল। বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশ পাবেনই। যদিও বঙ্গ রাজনীতির এটাই দস্তুর। ‘‌বাবু যত বলে, পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ’‌। যদিও বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশ সেবার হয়নি, বরং সেবার তৃণমূল খানিক ব্যাকফুটেই চলে গেছিল। তবুও মদন মিত্রর গলায় সে কী আত্মবিশ্বাস!‌ এখনও মনে আছে, ক্যাটক্যাটে হলদে পাঞ্জাবির গলায় হাত রেখে (‌যেন কলার তুলছেন)‌ বলেছিলেন, ‘‌হনুমানের বুক চিরলে যেমন রামসীতাকে দেখা যায়, আমার বুক চিরলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখা যাবে।’‌
মমতার প্রতি মদনের আনুগত্য নিয়ে সেই সময় অতি বড় নিন্দুকেও প্রশ্ন তুলতে পারবে না। তবুও তৃণমূলের অভিষেক জমানা শুরু হওয়ার আগে থেকেই একটু একটু করে ব্রাত্য হতে শুরু করেছেন মদন। মন্ত্রিত্ব নেই। সিঙ্গুর অনশনের মঞ্চ হোক বা বড় কোনও মিটিং— মমতার পাশে উপগ্রহের মতো ঘুরতে দেখা যেত তাঁকে। অন্য তিন উপগ্রহের মধ্যে পার্থ জেলে। তাঁর সরে যাওয়ায় মমতা বিশেষ বিচলিত হয়েছেন বলে মনে হয় না। সুব্রত বক্সী বরাবরই নীরবে থাকেন, তাঁর ভূমিকাটা নাকি অনেকটা ইয়েসম্যান গোছের। ববি আছেন বটে, তবে সেই পুরনো দাপট নেই। মন্ত্রিত্ব থাক বা না থাক, মদন ছিলেন মদনেই। কুর্সি নেই তো কী, এখনও এক হাঁকে পাঁচশো ছেলে জড়ো হয়। অঙ্গুলিহেলনী রোগী ভর্তি হতে পারে রাজ্যের তর্কযোগ্যভাবে সেরা হাসপাতাল এসএসকেএম–এ। সেদিনের রোগী ভর্তি করতে না পারাটা সম্ভবত মদনকে এই বার্তাই দিল, ‘‌ওহে, রাজপাট তো আগেই গেছে, এবার রাজসম্মানটাও যে আর নেই, সেটা বুঝে নাও।’‌
তৃণমূলে থাকার জন্য মদন মিত্রদের মন্ত্রী থাকা লাগে না। শাসকঘনিষ্ঠের রোয়াবটাই যথেষ্ট। এসএসকেএম, যা কি না মদনের খাসতালুক, সেখানে প্রত্যাখ্যান মানে যেন কেউ ইডেনে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সামনে ফটক বন্ধ করে দিয়েছে। সেদিনের পথদুর্ঘটনায় আহত রোগী কতটা রক্তাক্ত ছিলেন জানা নেই। এই অপমানে যে মুখে না বললেও মদনের হৃদপিণ্ড যে ক্ষতবিক্ষত হয়ে রক্তাক্ত হয়েছে তা বলাই বাহুল্য।
দলে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র যে সরছে, সেটা বোধহয় মদনও বুঝতে পারছেন। নইলে এসএসকেএম ইস্যুতে দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষের বিরুদ্ধে গুলিগোলা দেগে বসতেন না। সাদা পাজামা–পাঞ্জাবী, পায়ে স্নিকারের পাক্কা কংগ্রেসী সাজপোশাকের থেকে দল এখন জিনস টি–শার্ট আর হাতে স্মার্টওয়াচের প্রজন্মের দিকে ঝুঁকছে। মদন মিত্ররা এই দলে বেমানান। ঠিক যেমন সৌরভের দলের গৌতম গম্ভীররা শেষ অবধি টিঁকতে পারেননি ধোনির স্পার্টান মনোভাবের একাদশে মদন মিত্রদেরও সম্ভবত সেই দশা হতে চলেছে।
বাংলার রাজনীতিতে নেতা হওয়ার বরাবরই একটা বড় মাপকাঠি, কার হাতে কত লোক আছে, তার হিসেব। মদন মিত্রের রাজনৈতিক গতিবিধি সম্পর্কে যাঁরা জানেন, তাঁদের বিলক্ষণ মালুম আছে লোক জড়ো করতে মদনের জুড়ি নেই, ছিলও না কোনওদিন। কেন পারতেন মদন এইভাবে লোক জোটাতে?‌ সেই উত্তরও সেদিন গাড়িতে বসেই পেয়েছিলাম। প্রায় ঘণ্টাদেড়েক গাড়িতে ঘুরে ঘুরে ইন্টারভিউ চলেছিল। দেখছিলাম, কত লোকে মদনের গাড়ি দেখে এগিয়ে আসছিলেন এবং কার বাড়ির সামনে হাইড্রেন ভেঙে গেছে, কার ছেলের কোনও সার্টিফিকেট জোগার হচ্ছে না, সবই মদনের কণ্ঠস্থ। রাজনৈতিক রং দেখে মদন সাহায্য করেন, এই অপবাদ তাঁকে কেউ দিতে পারবেন না। যে মাটিতে তাঁর রাজনীতি, সেখানে তাঁর জনসংযোগের শিকড়টা অনেক গভীরে পোঁতা আছে। সেটাকে চট করে উপড়ে ফেলা মুশকিল!‌
মনে পড়ে যাচ্ছে সিঙ্গুরের সময় সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে তুড়ি বাজাতে বাজাতে মদনের সেই হুঁশিয়ারি, ‘‌এক থেকে দশ গুণব, এখান থেকে না সরলে, যা হবে তার দায়িত্ব আমার নয়।’‌ সেই ঝাঁঝাল নেতা মন্ত্রিত্ব হারানোর পরে ইমেজ ফিরে পেতে ফেসবুক লাইভ, ‘‌ওহ লাভলি’‌ কী–ই না করেছেন। তাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় হয়তো আলোচনায় থেকেছেন, কিন্তু কালীঘাটের ৩০ বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়িটার দরজার খিল মদন মিত্রের জন্য এমনভাবেই আঁটা যে বাড়ির কর্ত্রীর তাতে মন গলেনি।
অতি ভালবাসার মানুষ যখন মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখনই অভিমান তীব্রতর রূপ ধারণ করে। মদনের ক্ষেত্রেও হয়তো সেটাই হয়েছে। নইলে সামান্য একটা হাসপাতালে রোগী ভর্তি নিয়ে যে আকচাআকচির সূত্রপাত সেটা থেকে রাজনৈতিক সন্ন্যাসের কথা কেন ভেবে ফেলবেন মদন?‌
আসলে এখনও হয়তো মদনের বুক চিরলে মমতার ছবিই বেরবে। মমতার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে দূরে সরে যেতে যেতে আসলে তিনি কক্ষপথ যে বহুদূরে সরে গিয়েছেন, ক’‌দিন পরে সৌরজগতের বাইরে চলে গিয়ে বিস্মৃতপ্রায়ও হয়ে যাবেন, সেটাও হয়তো বুঝতে পারছেন তিনি। হয়তো সেই কারণেই রাজনীতি থেকে অবসরের কথা মদনের মুখে। আদৌ বরফ গলবে কি না কেউ জানে না, হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়িটার দরজার খিল আচমকাই মদনের জন্য খুলে যাবে কি না, তাও কেউ বলতে পারে না।
রাজনীতিতে সব সম্ভব।
নাকি মদন মিত্র অবসরই নিয়ে ফেলবেন?‌
সম্ভব, খুব সম্ভব। কারণ ‘‌মদন মিত্র দেরিতে হলেও কথা রাখে।’
‌তবে যাই ঘটুক, মদন মিত্রের বুক থেকে মমতার ছবি সরে যাবে?‌
অসম্ভব!‌

Share this post

Leave a Reply