You are currently viewing ডোভাল হ্যায়, তো মুমকিন হ্যায়

ডোভাল হ্যায়, তো মুমকিন হ্যায়

Share this post

পাকিস্তানের নানা শহরে যখন নাগাড়ে আছড়ে পড়ছে ভারতীয় বোমা, ড্রোন.‌.‌.‌ গোটা দেশ যখন প্রতিশোধের প্রত্যাঘাতে উল্লাসে ফুটছে, নয়াদিল্লিতে বসে ভদ্রলোক তখন কী করছিলেন?‌ এই প্রশ্নের উত্তর জানতে বড় ইচ্ছে হয়।
কেউ বলে তিনি প্রেত। আছে সবাই জানে। কিন্তু সেভাবে অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না। আবার কেউ বলে, তিনি হাওয়ার মতো। তাঁকে চোখে দেখা যায় না বটে। তবে কাজেকর্মে তাঁর উপস্থিতি হাড়েহাড়ে টের পাওয়া যায়। আবার কেউ বলে, তিনিই ভারতের জেমস বন্ড।
জেমস বন্ড?‌ নাহ, নায়কসুলভ পেশিবহুল চেহারা নয়। হাতে বন্দুক নিয়ে তাঁকে অ্যাকশনে নামতে কেউ কখনও দেখেছে বলে মনে করতে পারেন না। তবে বৃহস্পতিবার রাতে গোটা পাকিস্তান যখন জ্বলছে, তখন একজন ভারতবাসী হিসাবে তাঁকে, তাঁর মস্তিষ্ককে কুর্নিশ না জানিয়ে উপায় নেই।
সাধারণ ছা–পোষা মধ্যবিত্তের মতো চেহারা। পরনের নিপাট ইস্ত্রিকরা স্যুটটা খুলে সাধারণ শার্ট পরিয়ে দিলে তাঁকে আলাদা করা কার্যত অসম্ভব। দেখলে মনে হবে, তিনি পাড়ার পাশের বাড়ির স্নেহপ্রবণ কাকু। যিনি এই একটু পরেই কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বনগাঁ লোকালে চড়ে মহাকরণের কেরাণীর চাকরিতে কলম পিষতে যাবেন।
কলম?‌ হ্যাহ.‌.‌.‌ তাঁর আসল কাজ শত্রুদেশকে পেষা। এবং ওটাই তাঁর পেশা।
তিনি অজিত ডোভাল। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। পাকিস্তানকে যে যোগ্য জবাব বৃহস্পতিবার রাত থেকে দেওয়া শুরু হয়েছে, তারপরে তাঁকে নিয়ে গোটা দেশে ধন্যধন্য পড়ে যাওয়ার কথা। অথচ, বরাবরের মতো এবারও তিনি অন্তরালেই। কাজের কাজটা করে দিয়ে এবারও নীরবে নিভৃতে হয়তো কোথাও বসে শান্তমাথায় কফির কাপে চুমুক দিচ্ছেন।
নিঃসন্দেহে ভারতের সফলতম গোয়েন্দাদের একজন। বলা ভালো আইকনিক চরিত্র। অটল বিহারী বাজপেয়ীর জমানায়, ১৯৯৯–এ আফগানিস্তানের কান্দাহারে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া আইসি- ৮১৪ বিমান অপহরণ কাণ্ডে দেশের নাগরিকদের স্বার্থে জঙ্গি নেতা মাসুদ আজহারকে ছেড়ে দিতে হয়েছিল। সে দিন ভারতীয় নেগোসিয়েশন টিমের সদস্য ছিলেন এই দোভাল। সে বার দেশে ফেরার আগে, কান্দাহারে দাঁড়িয়ে দোভাল যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তা পূরণ হলো ২৬ বছর পরে, বৃহস্পতিবার মাসুদের ভাই, অপারেশন সিঁদুরে জঙ্গি নেতা রউফ আজহারের মৃত্যুতে। মিশন অ্যাকমপ্লিশড এবং রিভেন্ড টেকেন!
বরাবরের মতো পর্দার পিছনে থাকতে ভালোবাসা দোভাল এ বারেও দিন–রাত পরিশ্রম করে তৈরি করেছেন অপারেশন সিঁদুরের ব্লু প্রিন্ট। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই এখানে সব থেকে বেশি কাজে লেগেছে বলে দাবি সরকারি সূত্রের।
এই বয়সেও অক্লান্ত দোভাল ঠিক কতক্ষণ ঘুমোন বা বিশ্রাম নেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে দোভালের ঘনিষ্ঠ বৃত্তেরই। কর্মসূত্রে ১০ বছরের বেশি পাকিস্তানে ছিলেন দোভাল। পাকিস্তান যে পরমানু অস্ত্র বানাচ্ছে, তার খোঁজে নেমে একটি সেলুন থেকে বিজ্ঞানীদের কাটা চুল (‌কারণ চুলের নমুনায় পরমাণু বিকিরণের ছাপ থেকে যায়)‌ জোগাড় করেছিলেন তিনি। সেখান থেকে নমুনা নিয়ে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছিলেন পরমাণু অস্ত্রের কথা।
ভারত-পাক সীমান্তের যে এলাকায় জঙ্গি ঘাঁটিগুলি ছিল, সেই জায়গাগুলি সম্পর্কে দোভালের জ্ঞান অপরিসীম।‌ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো ‘অপারেশন সিন্দুর’-এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। অপারেশনের জন্য একটি বিশেষ দল তৈরি করা হয়েছিল এবং একটি কন্ট্রোলরুম থেকে পুরোটাই মনিটরিং করা হচ্ছিল। তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল এনএসএ অজিত ডোভালের হাতেই। ডোভাল সামগ্রিক পরিকল্পনা করে প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে আলোচনা করেন। বারবার তাঁরা মিটিং করেন। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কোনও নাগরিক নয়, পাক সেনা ঘাঁটি নয়, ‘অপারেশন সিন্দুর’-এর লক্ষ্যবস্তু হবে কেবলমাত্র সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটিগুলোই।
হামলার আগে নিশ্চিত করা হয় প্রতিটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে পাওয়া তথ্য। বিস্তৃত বিশ্লেষণ ও তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তৈরি করা হয় একটি বিশেষ গোপন রিপোর্ট, যা অজিত ডোভাল নিজে প্রধানমন্ত্রীকে দেখান এবং বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন। ডোভালের নিখুঁত পরিকল্পনায় সন্তুষ্ট হয়ে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি জানান। এরপর প্রতিরক্ষা মন্ত্রক, তিন বাহিনীর প্রধান, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং ডোভালের সঙ্গে আলোচনায় বসেন প্রধানমন্ত্রী। হাতে গোনা কয়েকজন উচ্চপদস্থ সেনাকর্তা ও ব্যক্তি ছাড়া কেউ জানতেন না এই রিপোর্ট ও সার্জিকাল স্ট্রাইকের বিষয়ে।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পরিচালিত উরি সার্জিকাল স্ট্রাইক এবং ২০১৯ সালে পাকিস্তানের ভূখণ্ডে বালাকোট স্ট্রাইকের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন তিনিই। ডোকলামে চীনা সেনার সঙ্গে সংঘাতের সময়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ডোভাল।
উত্তর-পূর্ব ভারতের বিদ্রোহ দমনে ডোভালের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৪৫ সালে উত্তরাখণ্ডে জন্ম ডোভালের। ১৯৬৮ সালে আইপিএস হওয়ার পর থেকে কেরিয়ারে উল্কাগতিতে উত্থান। ১৯৭১ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের অন্তত ১৫টি বিমান অপহরণ রুখে যায় তাঁরই নেতৃত্বে।
তিনি পাকিস্তানে সাত বছর আন্ডারকভার এজেন্ট হিসেবেও কাজ করেন। সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের গতিবিধি ও পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থার ওপর নজর রাখতেন ছদ্মবেশে। এক বছর গোপন এজেন্ট হিসেবে কাজ করার পর, পরবর্তী ছয় বছর ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশনে কাজ করেন। ১৯৮৪ সালে খালিস্তানি উগ্রপন্থীরা পাঞ্জাবের স্বর্ণমন্দির দখল করলে রিকশাওয়ালার ছদ্মবেশে ভেতরে প্রবেশ করে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। স্বর্ণমন্দির অভিযানও সফল হয়েছিল। তারপরে
১৯৯৬ সালে কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদীদের প্রভাব হ্রাস করে নির্বাচন অনুষ্ঠানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০০৯ সালে অবসর গ্রহণের পরও নরেন্দ্র মোদির সরকার তাঁকে ফিরিয়ে আনে। মোদি যে ভুল লোকের ওপর বাজি ধরেননি, তা প্রমাণ হয়ে যায় ২০১৪–তেই। সেই বছর ২০১৪ সালে ইরাকের তিকরিতে বন্দি ৪৬ জন নার্সকে উদ্ধারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন ডোভাল।
মিয়ানমারে NSCN-এর বিরুদ্ধে সফল অভিযানেও নেতৃত্ব দেন তিনি। ২০১৯ সালে তাঁকে পুনরায় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করে কেন্দ্রীয় সরকার। নরেন্দ্র মোদীর দ্বিতীয় মেয়াদে তাঁকে কেবিনেট পদমর্যাদাও দেওয়া হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধানরা অজিত দোভালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে গ্লোবাল ইনটেলিজেন্স নেওয়ার্কের মূল স্রোতে থাকার পরে দোভাল নাকি এখন বিশ্বের অনেকগুলি গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধানদের অন্যতম উপদেষ্টার কাজ করেন। এ হেন এক ব্যক্তি যে ভারতের মূল সম্পদ, এটা বুঝতে দেরি হয়নি পাকিস্তানের৷ তারপরেও তারা ব্যর্থ হয়েছে অজিত দোভালের মাস্টারস্ট্রোককে প্রতিহত করতে।
পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর প্রাক্তন প্রধান ফৈয়াজ় আহমেদের সঙ্গে জঙ্গি গোষ্ঠীর এক শীর্ষ নেতার কথোপকথনের ইন্টারসেপশন এসেছিল ভারতীয় গোয়েন্দাদের হাতে। সেখানেই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালকে ‘বো তো বুডঢা হ্যায়’ বলে সম্বোধন করেছিল এক জঙ্গি নেতা। সঙ্গে সঙ্গে তার কথায় প্রতিবাদ জানিয়ে প্রাক্তন আইএসআই প্রধান নাকি বলেছিলেন, ‘বুডঢা হোগা তেরা বাপ! পাকিস্তানের হাতে থাকা পরমাণু বোমার থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী অজিত ডোভালের ভয়ঙ্কর ক্ষুরধার মস্তিষ্ক।’‌
ছা–পোষা মধ্যবিত্ত চেহারার বুড়ো হাড়ের তেজ এখন হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে পাকিস্তান।

Share this post

Leave a Reply