মানুষ যত মাটির কাছে নু্য়ে থাকে, সে তত বড় হয়।
অরিজিৎ সিং সেই কথাটা বারেবারে প্রমাণ করেছেন। অন্তত আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তো তাই বলে। অরিজিৎকে আমি সাংবাদিক হিসেবে চিনি না। কীভাবে তাঁর মায়ের অসুস্থতার সময় তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছিল, কার মাধ্যমে যোগাযোগ হয়েছিল, সে সব কথা থাক। মোদ্দা কথা হলো যোগাযোগ হয়েছিল।
অভিনয়, রাজনীতি, সঙ্গীত— নানা জগতেরই নানা অতি পরিচিত মুখ অতীতে রক্তের দরকারে ব্লাডমেটসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। অনেকে রক্তদানও করেছেন। এসব নতুন কিছু নয়। তবু অরিজিৎ এঁদের মধ্যে আলাদা। অনেকটাই আলাদা।
প্রাথমিকভাবে তাঁর টিম থেকে একজন যোগাযোগ করে জানান, রক্ত লাগবে। এ বিষয়ে আবার ব্লাডমেটসের একটা ‘সখ্ত’ নীতি আছে। তুমি সেলেব্রিটি অথবা সেলেব্রিটির কেউ হলেও রক্ত পাওয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু নীতি মেনে চলতে হবে। সেই নীতি নিয়ে সামান্য খটাখটি হওয়ায় এবং যাঁর মাধ্যমে অরিজিতের টিম ব্লাডমেটসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল (তিনি নিজেও একজন লিভিং লেজেন্ড) তাঁকে জানানোয় দুম করে আমার ফোনে চলে আসে অরিজিতের ফোন।
‘প্রিয়ম? আমি অরিজিৎ বলছি। অরিজিৎ সিং। কী প্রবলেম হয়েছে, আমাকে বলুন।’
যেহেতু পেশাগত কারণে জীবনে বহু সেলেব্রিটির সঙ্গে গা ঘষাঘষি হয়েছে, তাই কোনও সেলেব্রিটির ফোন বা সাক্ষাৎ আমাকে দুম করে নড়িয়ে দিতে পারে না। তবে মিথ্যে বলব না, অরিজিতের সহজ গলার ফোন পেয়ে একটু বিস্মিতই হয়েছিলাম। কারণ, খ্যাতির শীর্ষে থাকলে মানুষ নিজেকে সাধারণত সর্বশক্তিমান মনে করে। অরিজিৎ সে সব করেননি, যে খটাখটি হয়েছিল, তার জন্য অদ্ভুত আন্তরিক উষ্ণ কণ্ঠে ‘সরি’ দিয়ে কথা শুরু করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘কাউকে কিচ্ছু বলতে হবে না। তুমি সরাসরি আমার সঙ্গে কমিউনিকেট করবে।’
হচ্ছিলও তাই। কোভিডের দ্বিতীয় ওয়েভ। রোজ একটি করে একটি নেগেটিভ গ্রুপের ডোনার পাওয়া সহজ নয়। তবু একএক দিন এক একজন ডোনার পাঠানো হচ্ছিল। তার আপডেট প্রতিদিন সন্ধে নাগাদ যাচ্ছিল অরিজিতের কাছে। অরিজিতও প্রতিবারই মাটিস্পর্শী বিনয় ও সৌজন্য নিয়ে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানাচ্ছিলেন ডোনারদের উদ্দেশে। এদিকে ততদিনে আমি নিজে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে পড়েছি। আক্রান্ত হওয়ার চতুর্থ দিন। গৃহবন্দী হয়ে মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে। ক্লান্তিতে অসাড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভাঙল সাড়ে আটটা নাগাদ। মনে পড়ল, আরে আজকের আপডেটটা তো দেওয়া হয়নি।
ফোন ঘোরাতেই ওদিক থেকে সহাস্য কণ্ঠে প্রশ্ন ভেসে এলো, ‘আরে! আজ এত লেটে কল করলে যে’। সবিনয়ে জানানো গেলো, আমি নিজেও কোভিড আক্রান্ত। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মায়ের রক্তের আপডেট পরে হবে, অরিজিৎ যে কী সৌজন্যে তারপর থেকে রোজ নিজে কল করে আমার শারীরিক অবস্থার খবর নিতেন, তা বলে বোঝাতে পারব না। মনে হতো কোনও পরমাত্মীয় যেন জেনুইন কনসার্ন থেকে খোঁজ নিচ্ছেন, দীর্ঘ ফোন কলে গল্প করছেন।
আরও একটি কাজ অরিজিৎ করেছিলেন, যা অবশ্যই সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখার জন্য নয়। তবু সেই কাজটি আমার জীবনে একান্ত ব্যক্তিগত মধুর স্মৃতি হয়ে থাকবে।
এত রক্তদাতা দিয়েও বাঁচানো যায়নি অরিজিতের মা–কে। কয়েক মিনিটের টাটকা মাতৃশোক বুকে নিয়েই অরিজিৎ প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোমরা অনেক সাহায্য করেছো। কী করতে পারি তোমাদের জন্য?’ বলেছিলাম, ‘তোমার সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক ফলোয়ার। রক্তের সংকট চলছে। ব্লাডমেটসের মতো অনেক সংগঠনই রক্তের কাজ করছে। নাম লেখার দরকার নেই, পারলে নিজের ফেসবুক পেজ থেকে তোমার ফ্যানদের রক্তদান করার অনুরোধ জানিয়ে একটা পোস্ট দিও।’
মাতৃবিয়োগের ২৪ ঘণ্টা কাটার আগেই কথা রেখেছিলেন অরিজিৎ। দীর্ঘপোস্টে রক্তদাতাদের ধন্যবাদ জানিয়ে নিয়মিত রক্তদানের আহ্বান জানিয়ে পোস্ট করেছিলেন ফেসবুকে।
অরিজিৎ নম্র, মাটির কাছাকাছি থাকা এক কিংবন্তি, বিনয়ী— এসব কথা সকলে জানেন। নতুন করে লেখারও কিছু নেই। তবু আত্মপ্রচারের এই কুশ্রী পৃথিবীতে এটুকু মনে করিয়ে দেওয়া যেতেই পারে, অরিজিতের বুকের মধ্যে একটা সুউর্বর মানবজমিন আছে। অরিজিৎ সেই মানবজমিন আবাদও করতে জানেন। করেছেনও। যে মানবজমিনে আবাদ করে সোনা ফলিয়েছেন তিনি। ফসল হিসেবে ফলিয়েছেন এক সোনা ঝলমলে হৃদয়।
ওঁর ভালো হোক।
অরিজিৎ নামের মানে তো যিনি শত্রুকে দমন করেন। ঔদ্ধত্য, অহং, অপরকে তাচ্ছিল্য করার প্রবণতা— এসবই তো মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। সেদিক থেকে আপনি সার্থকনামা।
জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা অরিজিৎ।