মহেন্দ্র সিং ধোনি। ভারতীয় ক্রিকেটের কিংবদন্তি বাহুবলী। কেউ বলেন ক্যাপ্টেন কুল, কেউ বলেন সর্বকালের সেরা ফিনিশার। নেহাতই পরিসংখ্যান কিংবা বিশ্বকাপ জেতা? না, সেটা হতে পারে না। কারণ, ধোনির চেয়ে বেশি রান করা ক্রিকেটার আরও কয়েকজন রয়েছেন, তাহলে কেন ধোনি সকলের চেয়ে আলাদা?
প্রথাগত ক্রিকেট পরিবেশের বাইরে থেকে উঠে এসেছিলেন ধোনি। আর ঠিক সেই কারণেই ধোনি সবার চেয়ে আলাদা। তাঁর স্ট্র্যাটেজি বানানো, প্ল্যান তৈরি করা গেম রিডিং— সবটাই একেবারে কপিবুক ক্রিকেটের বাইরে গিয়ে ভাবা। এই বিষয়টা দারুণ ব্যাখ্যা করেছিলেন গ্রেগ চ্যাপেল। তাঁর বইতে গ্রেগ লিখেছেন, ‘ধোনির গেম রিডিং দুর্দান্ত রকমের ভাল। ব্রেকের সময়টায় মাঠে কী চলছে বোঝার জন্য নির্দ্বিধায় ওর কাছেই চলে যেতাম সবার আগে।’ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে চ্যাপেলের খটাখটির পর্ব সকলেরই জানা। এবং ধোনির সঙ্গে অধিনায়কত্বের তুলনায় যাঁর নাম বারবার উঠে আসে, সেই সৌরভের সঙ্গেও ধোনির তুলনা করেছিলেন গ্রেগ। কীভাবে ড্রেসিংরুমের পরিবেশ বদলে দেন ধোনি, সেই কথা বলতে গিয়ে চ্যাপেল বলেছিলেন, ‘আমি তরুণ খেলোয়াড়দের সাথে আলাদা করে কথা বলতে গেলেই দেখতাম, তাঁদের মাথায় দারুণ দারুণ সব আইডিয়া আছে। অথচ টিম মিটিংয়ে কেউ মুখ খুলতে চাইত না। দলের সিনিয়র খেলোয়াড়রা যা বলতো, সেটাই তারা বেদবাক্য বলে মেনে নিত। অথচ ধোনি ক্যাপ্টেন হওয়ার পরে এই ব্যাপারটা একেবারে পাল্টে গেল। সকলে খোলা মনে কথা বলতো।’
শুধু দলে খোলা হাওয়া নয়, চাপের মুখে নিষ্পৃহ থাকার যে অলৌকিক ক্ষমতা ধোনির মধ্যে রয়েছে, সেটাও সতীর্থদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন ধোনি। কীভাবে? একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
সাংবাদিক ভারত সুন্দরসেনের লেখা ‘দ্য ধোনি টাচ’ বইতে এই বিষয়ের একটা দারুণ উদাহরণ দেওয়া রয়েছে। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি। ধোনি তখন সবে অধিনায়ক হয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে চলছে ওয়ান ডে ম্যাচ। তার আগে মাত্র ১৫টা ওয়ান ডে ধোনির অধিনায়কত্বে খেলেছে ভারত। সেই ম্যাচে ১৬০ রান তাড়া করতে হবে। সহজ টার্গেট চেজ করায় যখন মাত্র ১০ রান বাকি, তখন ক্রিজে রয়েছেন রোহিত শর্মা এবং ধোনি নিজে। আচমকাই ড্রেসিংরুমের উদ্দেশ্যে হাত নাড়লেন ধোনি। তিনি গ্লাভস পাল্টাতে চান। সচরাচর যেটা ঘটে, সেটা হল, গ্লাভস কিংবা জলের বোতল আনার ফাঁকে দ্বাদশ খেলোয়াড় ক্রিজে থাকা ব্যাটসম্যানের জন্য ড্রেসিংরুম থেকে কোচ কিংবা ক্যাপ্টেনের বার্তা নিয়ে আসেন। এখানে হলো ঠিক তার উল্টো। গ্লাভস পাল্টাতে পাল্টাতে ধোনি ড্রেসিংরুমের জন্য বার্তা পাঠালেন, জেতার পরে যেন ব্যালকনিতে ভারতীয় ক্রিকেটাররা খুব একটা উল্লাস না করেন। পাশাপাশি ক্রিজে থাকা রোহিতকে বলে দিলেন, জেতার পরে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারদের সঙ্গে এমনভাবে হ্যান্ডশেক করতে হবে যাতে তাঁদের মনে না হয় ফর্মের তুঙ্গে থাকা অস্ট্রেলীয়দের হারিয়ে ভারত আনন্দে ফেটে পড়ছে। বরং একটা উল্টো বার্তা যাক। এটাই নতুন ভারতীয় দল, অস্ট্রেলিয়াকে আর তারা অপরাজেয় বলে মনে করে না। তাই হারানোটাও খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। স্পার্টান লেখা ব্যাট নিয়ে ক্রিজে নামা অধিনায়ক ধোনির থেকে তো স্পার্টানদের মতো এই অনমনীয় মনোভাবই প্রত্যাশিত।
অধিনায়ক ধোনির ক্যাবিনেটে কাঙ্খিত সব বড় ট্রফিই আছে। এরই পাশাপাশি তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের তর্কযোগ্য সেরা ফিনিশার। ধোনির আগে অস্ট্রেলিয়ার মাইকেল বিভান এবং পরে দক্ষিণ আফ্রিকার লান্স ক্লুজনার ছাড়া কাউকে আর এই ভূমিকায় ভাবাই হয়নি। কেমন করে ফিনিশারের ভূমিকায় নিজের সেরাটা দিতে শুরু করলেন ধোনি? তার পিছনে রয়েছে যুবরাজ সিংয়ের অবদান। ধোনি তখন দলে নতুন এসেছেন। এদিকে যুবরাজ দলে সিনিয়র। নেট প্র্যাক্টিসে লম্বালম্বা ছক্কা হাঁকাচ্ছিলেন ধোনি। যুবরাজ এসে জিজ্ঞাসা করেন, কী কেমন চলছে? উত্তরে ধোনি বলেন, ‘বল দেখছি আর মারার চেষ্টা করছি।’ ধোনির মতোই লোয়ার–মিডল অর্ডারে ব্যাট করতেন যুবরাজ। দেশের হয়ে তিনিও বহু ম্যাচে ফিনিশ করেছেন। হাসতে হাসতে তিনি ধোনিকে বলেন, ‘একটু সময় যেতে দাও, কাঁধে চাপটা আরেকটু বাড়ুক, তখন বুঝতে পারবে, ছক্কার চেয়ে ম্যাচ জেতানোতেই মজা বেশি।’
ঠিক এখান থেকেই নিজেকে পাল্টাতে শুরু করেন ধোনি। পরে তিনি বলেছেন, ‘ফিনিশারদের তেমন কিছু পাওয়ার মতো নেই। বড় শট মারলেই যে সেটা কাজের শট হবে, এমন কোনও কথা নেই। ক্রিজে দাঁড়িয়ে থাকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমি তাড়াহুড়ো করি না। যতক্ষণ অবধি আমি এবং বোলার সমান চাপে না পড়ছি, ততক্ষণ অবধি শান্ত থাকি। এরপর দেখি কে বেশি ভালো চাপ সামলাতে পারে— আমি, নাকি বোলার?’ আর চাপ সামলানোয় যে ধোনির জুড়ি নেই, সেকথা কে না জানে।
কথা হচ্ছিল ফিনিশার ধোনিকে নিয়ে। কথা হচ্ছিল ধোনির গেমরিডিং নিয়ে। ২০১১ বিশ্বকাপে স্বপ্নের ফর্মে ছিলেন যুবরাজ সিং। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ফাইনালে পাঁচ নম্বরে নামার কথা ছিল যুবরাজের। কিন্তু ফর্মে থাকা যুবরাজকে সরিয়ে সেদিন নিজে পাঁচ নম্বরে নামেন ধোনি। শেষ বলে ছক্কা মেরে ম্যাচ জেতান। কারণ, আইপিলে শ্রীলঙ্কার স্পিনার মুথাইয়া মুরলীধরনকে অনেকবার নেটে খেলেছিলেন ধোনি। তাঁর মনে হয়েছিল, মুরলির ওভারগুলো তাঁরই মোকাবিলা করা উচিত। এটাই ধোনির গেমরিডিং। সেই কারণেই বিশ্বকাপ ফাইনালের মতো মঞ্চে নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হন না তিনি। বিশ্বকাপ ফাইনালের মতো মঞ্চে ফর্মে থাকা প্লেয়ারকে বসিয়ে নিজে মুরলীর মতো ভয়ঙ্কর স্পিনারকে সামলাতে মাঠে নেমে যাওয়ার আত্মবিশ্বাস থাকতে গেলে গেম রিডিং কতটা নিখুঁত হতে হয়, সেটা ধোনিকে দেখে শেখা উচিত।
ধোনি সম্পর্কে বলা হয় তিনি এমন ক্রিকেটার যিনি উইকেটের পিছন থেকে ম্যাচের রং পাল্টে দেন। ম্যাচের রং পাল্টানোর কৃতিত্ব সাধারণভাবে পান ব্যাটার কিংবা বোলাররা। তাহলে একজন উইকেটরক্ষক কীভাবে এই কৃতিত্ব অর্জন করলেন? সেটাও একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক। সকলেরই মনে আছে ২০০৭ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে শেষ ওভারে অনভিজ্ঞ যোগিন্দর শর্মার হাতে বল তুলে দিয়েছিলেন ধোনি। ভারত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।
ধোনিকে যাঁরা ততটা পছন্দ করেন না, তাঁদের অনেকেই মনে করেন যোগিন্দরের হাতে বল তুলে দিয়ে জেতাটা একটা ‘ফ্লুক’। এখানে অধিনায়ক হিসেবে ধোনির কোনও কৃতিত্ব নেই। সত্যিই কি তাই? তাঁরা ভুলে যান, এটাও ধোনির গেম রিডিংয়ের একটা অঙ্গ। অনেকেরই মনে নেই, ওই একই টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেও শেষ ওভার করে জিতিয়েছিলেন যোগিন্দর। খরচ করেছিলেন মাত্র ৬ রান। তাছাড়া ঘরোয়া ক্রিকেটে যোগিন্দরের বিরুদ্ধে খেলার সুবাদে ধোনি ভালমতোই জানতেন শেষ ওভারে রান আটকানোর ব্যাপারে যোগিন্দর কতটা দক্ষ। শেষের আগের ওভার আরপি সিং, শেষ ওভার যোগিন্দর শর্মা। ফাইনাল এবং সেমিফাইনাল দুটো ম্যাচেই এই ছক সাজিয়েছিলেন ধোনি। আর সেটা ঠান্ডা মাথায় ভেবেচিন্তেই সাজিয়েছিলেন।
কী করে এতটা মাথা ঠান্ডা রাখেন ধোনি? জানা যায়, যত বড়ই ভিভিআইপি হন না কেন, তাঁকে নাকি ফোনে পান না কেউই। ধোনি নাকি আসলে মোবাইল ফোনই ব্যবহার করেন না। ভীষণভাবে শ্রদ্ধাশীল নিজের অতীতের প্রতি নিজের শিকড়ের প্রতি। কখনও দুঃস্থ রোগীর জন্য অর্থ সাহায্য পাঠান কখনও আবার শৈশবের বন্ধু অসুস্থ জানতে পেরে এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সে করে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন। ঘনঘন ধোনিকে ব্যাটের লোগো পাল্টাতে দেখা যায়। কোনও কোম্পানির লোগো ব্যবহারের জন্য তাদের থেকে একপয়সাও নেন না ধোনি। আসলে বড় হওয়ার সময় যে যে কোম্পানির থেকে তিনি সাহায্য পেয়েছিলেন, তাদের স্টিকার ব্যবহার করে ধোনি তাদের ধন্যবাদ জানাতে চান। এর মধ্যে রয়েছে বিএএস, এসজি এবং স্পার্টান। অন্য ক্রিকেটাররা সেখানে এই ধরনের কোম্পানির লোগো ব্যবহারের জন্য গড়পড়তা পাঁচ কোটি টাকা নেন। ক্রিকেটের বাইরে সময় কাটান নিজের পরিবার আর প্রিয় মোটরবাইক নিয়ে। জনশ্রুতি আছে, আজও নাকি রাঁচির রাস্তায় হেলমেটে মুখ ঢেকে মাঝেমাঝে বেরিয়ে পড়েন ধোনি। নিরাপত্তার জন্য সঙ্গে থাকে একটি লাইসেন্সড রিভলবার।
এত অবধি দেখেশুনে মনে হতেই পারে। ধোনি বোধহয় কোনও পরিস্থিতিতেই ঘাবড়ে যান না। তিনি বোধহয় লোহায় গড়া স্নায়ু নিয়ে বাইশ গজে নামেন। অথচ এই ধোনিই একবার বলেছিলেন, ‘আমি যখন ব্যাট করতে নামি তখন প্রথম পাঁচ-দশটা বল খেলার সময়ে আমার হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে যায়। চাপ অনুভব করতে শুরু করি। ভয় পাই।’ সেই ভয়কে জয় করে বিপক্ষের হাঁটু কাঁপিয়ে দেওয়া যে সম্ভব, সেটাও প্রমাণ করেছেন তিনি। প্রমাণ করেছেন আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো রক্তমাংসের শরীর নিয়েও এই ৪১ বছর বয়সেও তাঁর জন্যই কলকাতার গ্যালারি নাইট রাইডার্সের বেগুনির বদলে ছেয়ে যায় চেন্নাই সুপার কিংসের জার্সির রঙ হলুদে।
তাই ২০২৩ সালেও ধোনি যখন মাঠে নামছেন, দেখা যাচ্ছে গ্যালারি আজও ফেটে পড়ছে, কারণ আজও তো ‘মাহি মার রাহা হ্যায়’।