You are currently viewing ‘‌এই করেছো ভাল.‌.‌.‌’‌

‘‌এই করেছো ভাল.‌.‌.‌’‌

Share this post

উৎসব আসছে। উৎসব যেমন ঘরে প্রত্যাবর্তনের, মিলনের, তেমনই একাকিত্বেরও। যতটা আনন্দের, ততটা বিষাদেরও। প্রবাসে থাকেন যাঁরা, সারাবছর কাজের চাপে একান্তে থাকেন যাঁরা, এই ক’‌টাদিন তাঁরা বাকি সকলের সঙ্গে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করেন। আবার মিশে যাওয়ার উপায় নেই যাঁদের, আসলেই যাঁরা একা— তাঁদের কাছে উৎসবের ক’‌টা দিন বড়ই অসহনীয়। তাঁদের মনে হয়, দ্রুত সব শেষ হয়ে সাধারণ কর্মব্যস্ততায় ফিরুক জনজীবন। দুর্গাপুজো, দোল, নিউ ইয়ার্স ইভ— প্রতিটা উৎসবেই সামাজিক মাধ্যমে সেলিব্রেশনের ছবি দেখতে পাই। পাওয়াই উচিত। সেটাই সুস্থ স্বাভাবিকত্বের লক্ষণ। কিন্তু কখনও আমরা এটা খেয়াল করি না, কারা সেলিব্রেট করছেন না। নিঃসঙ্গতা, বন্ধুহীনতায় কে কে নিজেকে চার দেওয়ালের মধ্যে গুটিয়ে রাখছেন। ভুলে যাই বছরের আর পাঁচটা দিন তবু একরকম, উৎসবের দিনগুলোয় কিন্তু নিঃসঙ্গতা আরও বেশি করে কামড় বসায়। উৎসব যেমন একদিকে মানুষকে কাছাকাছি এনে দেয়, তেমনই দিনবিশেষে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, সে কতটা একা। উৎসবের কথা বলতে বসলে আমরা শুধু রোশনাইয়ের জমায়েতটা নিয়েই কথা বলি। বিষণ্ন ধূসর আঁধার নিয়ে কোথাও খুব একটা কিছু বলা হয় না। বলা হয়নি।
‘‌দাদার কীর্তি’ দেখছিলাম। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প থেকে সিনেমাটা তৈরি করার সময় কাহিনীর খোলনলচে আমূল পাল্টে ফেলেছেন তরুণ মজুমদার। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে পরিচালকরা গল্পটাই ঘেঁটে ফেলেন। তবে তরুণ মজুমদারের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি।
‘‌দাদার কীর্তি’‌–তে শমিত ভঞ্জ উৎসবের দিনে প্রবাস কাটিয়ে ঘরে ফেরেন। দেখা হয় বন্ধু, স্ত্রী, আত্মীয়পরিজনদের কাছে। আবার উৎসবের দিনেই অনুতপ্ত ফুলদা নিজেকে সকলের থেকে সরিয়ে একা সুনসান বসে থাকেন রেল লাইনের পাশে। অলক্ষ্যে দেখতে থাকেন নিম্নবিত্ত অবাঙালি রেলকর্মচারীদের সহজ পারিবারিক উৎসবযাপন।
এই দোরোখা ছবিতে শমিত ভঞ্জের বাড়ি ফেরাটা যতটা আনন্দ দেয়, ফুলদাদের একা বসে থাকা বসে থাকাটাও ততটাই নাড়িয়ে যায়।
আমি তরুণ মজুমদারের ভক্ত। তরুণ মজুমদার ভালবাসার গল্প বলতেন, সারল্যের গল্প বলতেন, সেখানে গ্ল্যামারে ঝকমকানো নায়িকা ছিল না, থ্রিলারের চমক দেওয়া নায়কের প্রবল স্মার্টনেস ছিল না। দিনের শেষে গিয়ে সহজ জীবনের অতিমৃদু জয়গান ছিল। যা আছে, তা অতি সূক্ষ্ম, সাটল, মৃদু। মহৎ কিছু না করেও বেঁচে থাকার সহজ তিরতিরে আনন্দ। দাদার কীর্তি, পলাতক, ভালবাসা ভালবাসা… এই সিনেমাগুলোগুলো দেখে আমি বিশ্বাস করতে শিখেছিলাম, জটিল-কুটিল এই দুনিয়ায় বোকা লোকদের, সরল লোকদের এক না এক সময়ে গিয়ে জয় হয়।
কথায় বলে, একটা বন্ধ ঘড়িও দিনে দু’‌বার অন্তত সে ঠিক সময় দেয়। তেমনই মানুষও। যার কোনও গুণ নেই বলে মনে হয়, তার মধ্যে খুঁজলেও অন্তত একটা গুণ বেরবেই। তেমনই পড়াশুনো না হোক, ফুলদার ছিল গান। ‘‌চরণ ধরিতে’‌ যখন সে গাইতে শুরু করে, তখন পিয়ানোয় বসা সরস্বতীর চোখে–মুখে আলো যেন খানিক বেড়ে যায়।
ফুলদার মতো সোনাবাঁধানো মন যাঁদের, তাঁরা আমাদের সমাজের একটা বিরাট অংশের প্রতিনিধি। যাঁদের বুক ফাটে, তবু মুখ ফোটে না। সোজা কথা সোজাভাবে বলে ফেলার ‘অপরাধে’ যাঁদের ভুল বোঝেন অনেকে। তাঁরাই ক্রমশ গুটিয়ে যান, নিঃসঙ্গতার অন্ধকারে। বিচ্ছিন্ন করে নেন নিজেদের। আমরা যারা ‘আহা, আমাদের কী রসবোধ’ প্রমাণ করতে গিয়ে যাঁরা রসিকতার নামে ঠুকরে ঠুকরে রক্তাক্ত করি নিঃসঙ্গ মানুষগুলোকে, তাঁরা কি ক্রমশ অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া ফুলদাদের খবর রাখি? উৎসবের দিনে এই ফুলদা–রা কি আরও বেশি নিঃসঙ্গে হয়ে পড়ে না?‌
পাঠক, হে প্রিয় পাঠক, বুকে হাত রেখে বলুন তো, ফুলদার এই একা রেললাইনের পাড়ে বসে থাকার এই একটা দৃশ্যে কি আপনি অন্তত একবারের জন্যও ফুলদার সঙ্গে ‘‌রিলেট’‌ করে ফেলেন না নিজেকে। কখনও আপনার জীবনে এরকম অন্তত একটা পরিস্থিতি একবারের জন্যও আসেনি, যখন আপনি আপনার বন্ধুদের কাছে কোনও সদ্যপরিচিতার সম্পর্কে আপনার মুগ্ধতার কথা জানাতে চেয়েছেন। আবার এই ভেবে ঢোঁকও গিলে নিয়েছেন, তারা কী ভাববে?‌ পিছনে লাগবে না তো?‌
ফুলদার মধ্যে আসলে কোনও ইনহিবিশনই ছিল না। তার অপার সারল্য তাকে শিখিয়েছিল, যা ভাল, তা মুখ ফুটে বলতেই হয়।
এই সারল্যই তাকে শিখিয়েছিল, জীবনের আসল শিক্ষা হল ভাল, সরল মানুষ হওয়া। যে মানুষকে প্রয়োজনে আত্মত্যাগও করতে হতে পারে। বুকে পাথর চাপা দিয়ে হলেও নিজের জায়গা ছাড়তে হতে পারে। ভালবাসার মানুষটার সুখের জন্য, নিশ্চিত ভবিষ্যতের নিজের চরমতম আত্মত্যাগ করার শিক্ষা আয়ত্ত করা, নিজের চেয়েও ভালবাসার নিকটজনের আনন্দকে প্রাধান্য দেওয়া— সেটাই তো আসল শিক্ষা। সেই শিক্ষা যাঁর আছে, তিনিই তো আসল শিক্ষিত, তিনিই তো আসল বিদ্বান। তিনিই তো খাঁটি হিরে!‌
দাদার কীর্তিতে মহুয়া রায়চৌধুরীরের চরিত্রটার নাম যে কেন সরস্বতী, তা এতদিনে বুঝলাম। বিদ্যার দেবী সরস্বতী কখনও সত্যিকারের হিরে চিনতে ভুল করেন না। আজকাল শুনি, সরস্বতীপুজোই নাকি বাঙালির ভ্যালেন্টাইন্স ডে। যদি সেটাই হয়, ডিগ্রি আর ওপরচালাকির বনাম সারল্যের যুদ্ধে সারল্যেরই জয় হোক। বিদ্যা হোক প্রেম— সব ফুলদার সরস্বতীলাভ হোক এবছর। সঙ্গে থাকুক এই প্রার্থনা— মা সরস্বতী, আমাকে বিদ্যে দাও মা। আমাকে বুদ্ধি দাও। ডিগ্রির বাজারে যাই হোক না কেন, জীবনের ময়দানে যেন ফুলদার মতো সোনাবাঁধানো সহজসরল একটা মনের মতো মন পাওয়ার শিক্ষাটুকু অর্জন করতে পারি।
আজকাল শুনি, সরস্বতীপুজোই নাকি বাঙালির ভ্যালেন্টাইন্স ডে। যদি সেটাই হয়, ডিগ্রি আর ওপরচালাকির বনাম সারল্যের যুদ্ধে সারল্যেরই জয় হোক। বিদ্যা হোক প্রেম— সব ফুলদার সরস্বতীলাভ হোক এবছর। সঙ্গে থাকুক এই প্রার্থনা— মা সরস্বতী, আমাকে বিদ্যে দাও মা। আমাকে বুদ্ধি দাও। ডিগ্রির বাজারে যাই হোক না কেন, জীবনের ময়দানে যেন ফুলদার মতো সোনাবাঁধানো সহজসরল একটা মনের মতো মন পাওয়ার শিক্ষাটুকু অর্জন করতে পারি।
আমরা বোকা। তাই উৎসবের দিনে শুধুই লাইমলাইট ফেলি শমিত ভঞ্জদের দিকে। ভুলে যাই ফুলদাদের।
আমি প্রবলভাবে নাইন্টিজে বাঁচি। সেময় পাড়ার ক্লাবে আড্ডা ছিল। আনন্দমেলা ছিল। লাল সিমেন্টের মেঝের ঘর ছিল। আটপৌরে করে শাড়ি পরা কাকিমা জেঠিমারা ছিলেন। যাঁরা সারাদিন সন্তানের অমঙ্গল আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে থাকতেন। পুজোর পরপরই হাওয়ায় শীত আসার শিরশিরানি ছিল। বিপদে–আপদে পাড়ার সকলে ঝাঁপিয়ে পড়া ছিল। আনন্দমেলা ছিল। লোডশেডিংয়ের রাস্তায় সকলের জড়ো হয়ে আড্ডা ছিল। পুজোর সময় ক্লাবের বিচিত্রানুষ্ঠান ছিল।পাড়ার ছেলেমেয়েরাই সেখানে গাইত, নাচত। বিয়ে–অন্নপ্রাশনে খেতে বসলে কাঠের ফোল্ডিং চেয়ার, কলাপাতা আর মাটির খুরি ছিল।
কাউকে ভাল লেগে গেলে তার চোখে চোখ পড়লে সলজ্জ চোখ নামিয়ে নেওয়া ছিল। ক্রাশ শব্দটা তখনও জন্মালেও এ বঙ্গভূমে পদার্পণ করেনি। লক্ষ্মীমন্ত মুখের সুন্দরীদের বিনুনি বেঁধে শাড়ি পরে স্কুলে যেতে দেখলে তাদের দিকে তাকানোও ছিল। তবে সেই দৃষ্টিতে থাকত শুধুই মুগ্ধতা। অশ্লীলভাবে ব্যাঁকা নজরে ঠোঁট কামড়ানো থাকত না। মোবাইল হোয়্যাটস্‌অ্যাপ ফেসবুক— কল্পনাও করা যেত না। বড়জোর স্কুলে কিংবা টিউশনে আসা–যাওয়ার ফাঁেক সামান্য দশ–পাঁচ মিনিট পাশাপাশি সাইকেল নিয়ে হাঁটা। সে একটা সময় ছিল বটে। পাড়ার ছেলেরা একসঙ্গে আড্ডা মারতে বসতো অফিস থেকে ফিরেই। বেকারদের তো পোয়াবারো। তাদের আড্ডা সারাদিনই চলছে। ক্লাবে ক্যারাম পিটতে পিটতে। সে সব দৃশ্য দেখতে দেখতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বীণার লাবণ্য আর সরস্বতীর ব্যক্তিত্ব মেশানো একটা লক্ষ্মীমন্ত মুখ। লাল সিমেন্টের মেঝের ঘরে দাঁড়িয়ে যে চোখ তুলে জানলার এপারে দাঁড়িয়ে থাকা প্রেমিককে বলবে, ‘‌‌তোমার শরীর ভাল আছে?‌ যাও, বেশি হিম লাগাতে হবে না।’‌
তাদের চোখে একটা অদ্ভুত নিষ্পাপ সারল্য থাকত। যেন পৃথিবীর কোনও খারাপ কিছু সেই চোখ দেখেনি। দেখবেও না। রাগ থাকবে, অভিমান থাকবে, সারল্য থাকবে, ঝগড়া। এই মনে হবে, সব বোধহয় শেষ হয়ে গেল। কিন্তু দিনের শেষে ভুল বোঝাবুঝি মিটে যাবে। সব ঠিকও হয়ে যাবে।
আর কী ছিল?‌ পাড়ায় পাড়ায় একটা করে ভোম্বলদা থাকত। যে কোনও বিপদ–আপদে যার দ্বারস্থ হওয়া যেত। বিপদে সে–ই এগিয়ে এসে লিড নিত। বন্ধুদের মধ্যে সন্তুর মতো ঠিক কেউ না কেউ এমন একজন থাকত, যার একটা সেট্‌ল প্রেম হয়েছে। বাড়িতেও জেনে গেছে কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সেটা নিয়ে কোনও বাড়িতে কোনও সমস্যা নেই। সেই সময়, তাপস পালের মতো চরিত্রগুলোর চোখে একটা অদ্ভুত নিষ্পাপ সারল্য থাকত। যেন পৃথিবীর কোনও খারাপ কিছু সেই চোখ দেখেনি। দেখবেও না। সাময়িকভাবে হয়তো কূটনীতির চাপে পড়ে ফুলদার মতো লোকজন একটু নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন, কিন্তু শেষে গিয়ে সব ঠিক হয়ে যায়। মাঝের এই সময়টুকু পার করা খুব চাপের। সকলে সেই চাপ নিতে পারেন না।
বিদেশে শুনেছি ইস্টার কিংবা ক্রিসমাসের সময় সরকারের পক্ষ থেকেই যাঁরা একা থাকেন, তাঁদের ওপরে বিশেষ নজর রাখা হয়। খোঁজখবর নেওয়া হয়। আমাদের দেশে সেসবের চল নেই। তাই আমাদের দেশে সমাজে বিনা অপরাধে সাজা পাওয়া ফুলদাদের জায়গা হয় নির্জনে।
ফ্যাশন হোক বা ইনসিডেন্ট। আমাদের জীবনে সব পুরনো জিনিস ঘুরে ঘুরে আসে। দেখবেন, এক না একদিন ভোম্বলদা, ফুলদা, বীণা, সরস্বতী, পদারা আমাদের ফ্ল্যাটের ঘুপচি জীবনে ফিরে আসবেই। জানলার ধারে দেখা করতে আসা সন্তুর সামনে গুটিগুটি পায়ে এসে দাঁড়াবে বীণা। ভুল বোঝাবুঝি মিটে গিয়ে ফুলদার পাশে এসে দাঁড়ানোর আগে বৌদির বুকে মাথা গুঁেজ হাউহাউ করে কেঁদে হাল্কা হয়ে নেবে সরস্বতী।
দেখবেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। সিনেমার মতোই। কারণ, কেউ একটা বলেছেন.‌.‌.‌‘‌ফিল্মো কি তরাহ, হমারি জিন্দেগি মে ভি এন্ড তক সব কুছ ঠিক হি হো যাতা হ্যায়। হ্যাপিইইজ এন্ডিং। অগর ঠিক না হুয়া তো বো দি এন্ড নহি হ্যায় দোস্তো।’‌
সব একাকী নিঃসঙ্গদের উৎসবের শুভেচ্ছা। বিশ্বাস করুন, সব ঠিক হয়ে যাবে। হবেই।

Share this post

Leave a Reply