আমি শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম, একটা মানুষ কতটা নিষ্ঠাবান হতে পারেন। ইডেনে চাঁদিফাটা গরমে আচমকাই তাঁর মনে হল, কভার ড্রাইভটা বোধহয় নিখুঁত হচ্ছে না। অতএব বুলাও বোলার লোগো কো। লোকাল বোলাররা একের পর আসছেন, আর তিনি কভার ড্রাইভ মেরে যাচ্ছেন।
কে যেন বলেছিলেন, পৃথিবীর মধুরতম শব্দ হচ্ছে উইলোর কাঠে আর ক্রিকেট বল ধাক্কা খাওয়ার পরে ‘টাক্’ করে যে শব্দটা হয়, সেইটা! কিন্তু সাড়ে পাঁচফুটের যে গাঁট্টাগোট্টা চেহারাটা নেটে প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে কভার ড্রাইভ মেরে যাচ্ছে, আর তাতে যে শব্দটা হচ্ছে, সেটাকে নেহাত শব্দ বলা চলে না। টাক-টাক শব্দটা সামান্য শব্দ থেকে মিউজিকে পরিণত হচ্ছে আমার চোখের সামনে। যে ক্ষিপ্রতায় মোজার্টের আঙুল ঘুরে বেড়াত পিয়ানোর ওপরে, যে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটে সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি (মানে একশোটা শতরান)হয়ে গেছে। ওয়ার্ল্ড কাপ জেতা হয়ে গেছে। ডন ব্র্যাডম্যানের পিঠ চাপড়ানি পাওয়া হয়ে গেছে। উদ্ধত অস্ট্রেলিয়ানদের কাছে থেকে সমীহ আদায় হয়ে গেছে। আভিজাত্যে ভরপুর ক্যারিবিয়ানদের থেকে বাহবা আদায় হয়ে গেছে। এমনকী চিরশত্রু পাকিস্তানের থেকে সম্ভ্রম আদায় হয়ে গেছে। তিনিই যে সেরা, সেরা সেটা নিয়ে কারও মধ্যে কোনও বিতর্ক নেই। আর কি কিছু পাওয়ার বাকি থাকতে পারে একজন ব্যাটসম্যানের?
পারে।
কেরিয়ারের শেষের আগের টেস্টে নামার আগে তাঁর পাওয়ার বাকি পারফেকশন। দিনের শুরুতে আচমকা লাফিয়ে ওঠা বল ব্যাটের কাণায় লেগে স্লিপের দিকে চলে গিয়েছিল। তাতেই তাঁর মনে হয়েছিল, নাহ্ কভার ড্রাইভটা বোধহয় একটু শুধরে নেওয়া দরকার। তাই একটানা দু’ঘণ্টা ধরে তিনি ওই একটাই শট মেরে যাচ্ছেন। এমনও হতে পারে পরের দিনের টেস্টে কোনও বল আচমকা লাফালই না। কিংবা কোনও রান না করেই আউট হলেন তিনি। তাতেও কি বিন্দুমাত্র জৌলুস কমবে তাঁর কীর্তির? একেবারেই না।
আমার মতো তুচ্ছ স্পোর্টস জার্নালিস্ট এবং ভক্তের কথা যদি বাদও দিই, তিনি আপামার ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে ঈশ্বর ছিলেন, আছেন, থাকবেন।
কিন্তু গাঁট্টাগোট্টা চেহারের মানুষটি সে সব যেন জানেনই না। চোখমুখ কুঁচকে নেটে দাঁড়িয়ে আছেন। হেলমেটে তেরঙা। যুদ্ধে নামার আগে যেভাবে শেষবার সস্নেহে নিজের প্রিয় তলোয়ারে হাত বুলিয়ে নেয় কোনও যোদ্ধা, তেমনই পরম মমতায় মাঝে মাঝে হাত রাখছেন নিজের ব্যাটে। বোলারের হাত থেকে বল মাটিতে পড়ার পরেই স্রেফ বলের হাওয়ায় ভাসা দেখেই বুঝে যাচ্ছেন যেন সেটা কোন দিকে টার্ন নেবে। কোন অলৌকিক ক্ষমতা যেন। সবিষ্ময়ে দেখছিলাম, যে বলগুলো তিনি জাজমেন্ট দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছিলেন, তার একটাও কাভার ড্রাইভ মারার মতো জায়গায় পিচ করছে না। আর যেগুলো পিচ করছে, ‘টাক’ করে একটা শব্দ হচ্ছে। আর বল আছড়ে পড়ছে নেটের গায়ে সপাটে। এ চলল অনেকক্ষণ। ততক্ষণ, যতক্ষণ না ঈশ্বরের মনে হল, হ্যাঁ এবার বোধহয় থামা যেতে পারে। এতক্ষণ নেট বোলার হিসেবে তাঁর সঙ্গে প্র্যাক্টিস করছিল স্থানীয় বোলাররা। হেলমেট খুলে তাঁদের সঙ্গে সেলফির আবদার মেটালেন। অটোগ্রাফ দিলেন। গাল টিপে আদরও করলেন একজন। সঙ্গে স্নেহের সুরে কিছু একটা বললেনও সম্ভবত। তখন অনেকটাই দূরে দাঁড়িয়ে আমরা। ঘামে সপসপে ভেজা চুলে হাত বোলাতে বোলাতে চোখমুখ কুঁচকে ক্লাবহাউসের দিকে হাঁটা শুরু করলেন তিনি। বলাই বাহুল্য, ততক্ষণে থিকথিকে ভিড় জমে গিয়েছে পুলিসি ব্যারিকেডের এপ্রান্তে। না শুধু পেশাগত তাগিদে দাঁড়িয়ে থাকা আমার মতো সাংবাদিকরা নন। আমাদের গায়েই গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ক্রিকেটের একগাদা কিংবদন্তি। তাঁরাও রোদে দাঁড়িয়ে ঘামতে ঘামতে দেখে নিচ্ছেন আর এক কিংবদন্তির প্রায় শেষ যুদ্ধের অনুশীলন। সেই ভিড় যে কতো হেভিওয়েট, সেটা ওখানে দাঁড়ানো দু’জনের নাম বললেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। ১) ওয়াসিম আক্রম। ২) ইয়ান বিশপ। একটি চ্যানেলের হয়ে ধারাভাষ্য দিতে কলকাতায় এসেছেন তাঁরা। ঈশ্বর তাঁদের দিকে এগিয়ে এলেন। হাসিমুখে কুশল বিনিময় করলেন, তারপর ফের হাঁটা লাগালেন সাজঘরের দিকে। পরেন তাঁর কালো হাফপ্যান্ট, ছাইরঙের টি-শার্ট। দুটোই ঘামে ভিজে গেছে। আমরা, যাঁরা তাঁর সঙ্গে দু’মিনিট কথা বলার জন্য সকাল থেকে অপেক্ষা করছিলাম, তারা ততক্ষণে পড়ি কী মরি করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। পারিনি। পুলিস আটকে দিয়েছে যে। ততক্ষণে খবর পেয়েছি, সিএবি-র বারান্দায় ঈশ্বরকে একটা কেক উপহার দেবে মনজিনিস। মনজিনিসের এক কর্মকর্তার সঙ্গে সামান্য আলাপ ছিল। নিজেকে বললাম, ওহে আজ যদি তুমি ওই কনট্যাক্টকে কাজে না লাগাতে পারো, তাহলে কীসের সাংবাদিক তুমি। বহু অনুনয় বিনয়ের পরে অনুমতি মিলল। ঈশ্বর কেক কাটবেন। তারপরে বারান্দা ধরে হেঁটে উঠে যাবেন ভিভিআইপি রুমের দিকে। গোটা ঘটনাটা ঘটবে খুব বেশি হলে ১০ সেকেন্ড ধরে। যদি কোনও কথা বলার থাকে, তাহলে যেন ওই দশ সেকেন্ডেই বলে নিই। দেখলাম, একই অনুমতি জোগার করেছেন আরও তিনজন সাংবাদিক। ভাবলাম তাই সই। কেক কাটার সময় বিরক্ত করিনি। ঈশ্বর কেক কাটলেন। তারপরে হাসিমুখে ক্যামেরার সামনে পোজও দিলেন। যেই হাঁটা শুরু করলেন সিঁড়ির দিকে, অমনি কাঁপা গলায় ঈশ্বরের সামনে গিয়ে বললাম, ‘এক্সকিউজ মি স্যার…’। অবোধ ভক্তের আনাড়ি হাতের পুজোয় ভগবান যেমন স্নেহের হাসি হাসেন, ঠিক তেমন করেই হেসে উঠলেন ঈশ্বর। আমার কাঁধে সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য হাত ছুঁইয়ে তিনি বলে ছিলেন, ‘প্লিজ মুঝে স্যার মত বুলাও। তুম তো বেঙ্গলি লগতে হো। বেঙ্গলি মে তো দাদা বোলতে হ্যায়। ওহ ভি বহুত সুইট ওয়ার্ড হ্যায়।‘
সচিন রমেশ তেন্ডুলকরের ইন্টারভিউ সে যাত্রা আমার নেওয়া হয়নি। তবে আমার ঈশ্বর, আমার পৃথিবী, আমার ভালবাসা যে টি-শার্টে নিজের ডানহাত ছুঁইয়েছিলেন, সেটা এখনও সযত্নে রাখা আছে আমার কাছে।

ঈশ্বর, পৃথিবী, ভালবাসা!
ছিঁচ-কাদুনে বাচ্চা হিসেবে বদনাম কোনও দিনই ছিল না। জনসমক্ষে শেষবার কেঁদেছি ২০০৭ সালে— সুকান্ত মঞ্চে স্টেজ থেকে জীবনের শেষ শো-টা করে গ্রিন রুমে ঢোকার পরে (দরকার নেই, তবুও বলি এক সহপাঠিনীকে জড়িয়ে ধরে চোখের জলে তার সালোয়ারের কাঁধ ভিজিয়ে ফেলে ছিলাম)। সেই অনুভূতিটা ফিরে এসেছিল শচীনের অবসরের দিন। টিভিতে মাইক হাতে কাঁপা কাঁপা গলায় বিদায়ী ভাষণ দিচ্ছিলেন সচিন। জ্ঞানইস্তক লোকটাকে কোনওদিনও সৌরভ, রবি শাস্ত্রী, রিচি বেনোর মতো সুবক্তা মনে হয়নি। নিজে গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। তায় আবার হাল্কা তোতলা! তাই যারা ভাল কথা বলে, তাদের প্রতি ঈষৎ হিংসে মেশানো আকর্ষণ ফিল করি! কিন্তু আজ সৌরভ, শাস্ত্রীরা ফেল। এক্কেবারে ডাহা ফেল। সচিন যখন বলছেন, ‘আমার জীবনের সেরা পার্টনারশিপটা অঞ্জলির সঙ্গে…’ হাততালি দিয়ে উঠেছিলাম। পরক্ষণে খেয়াল হল, আমি কেঁদে ফেলেছি। সেটা লোকসমক্ষে স্বীকার করতে একটুও লজ্জা নেই, বরং গর্ব আছে। কারণ আমি সচিনকে দেখেছি।কতটা সততার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলে একটা চিরকালের মুখচোরা লোক এক স্টেডিয়াম দর্শককে কাঁদিয়ে ফেলতে পারে!
আমি ভিভকে দেখিনি। ব্র্যাডম্যান কিংবা গাভাসকরকেও না। তবে শচীন রমেশ তেন্ডুলকরকে দেখেছি। কীভাবে একজন বেঁটেখাটো গোঁট্টাগাট্টা লোক ২৪ বছর ধরে ২২ গজে নেমে গোটা দেশকে একই সুতোয় বেঁধে ফেলতেন, সেই অলৌকিক দৃশ্য দেখেছি। প্রতিটা বাউন্ডারিতে গোটা দেশকে হাসতে দেখেছি। প্রতিটা আউটে কাঁদতে দেখেছি। টেনিস এলবো ধরা পড়ার পরে শচীন ভক্তকে আত্মহত্যা করে ফেলতে দেখেছি। ব্যাট করতে নামলে গাড়িঘোড়া কমে যেতে দেখেছি, রাস্তা জনশূন্য হয়ে যেতে দেখেছি। দৈনন্দিন জীবনের সব না পাওয়গুলোকে ভুলতে দেখেছি প্রত্যেকবার সেঞ্চুরির পর ব্যাট আর হেলমেট খুলে আকাশের দিকে তাকানোর মধ্য দিয়ে।
আমি শচীন তেন্ডুলকরকে দেখেছি।
শুভ জন্মদিন আমার ঈশ্বর, আমার পৃথিবী, আমার ভালবাসা।
কালের নিয়মে অনেক বড় প্লেয়ার আসবে, রেকর্ড ভাঙবে, কিন্তু একশো কোটি মানুষের জনজীবন স্তব্ধ করে দেওয়া হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা বোধহয় ইহজীবনে আর দেখা হবে না।