বুদ্ধিজীবী তো মোটামুটি আজকের দিনে একটা গালাগালই হয়ে গেছে। শাসকের ঘনিষ্ঠ হতে সমাজের বিশিষ্টজনরা চেয়ার মুছতেও বাকি রাখেন না, এই রকম একটা ক্ষোভের সুর মোটামুটি সোশ্যাল মিডিয়ায় কান পাতলেই শোনা যায়। আচ্ছা কী হয়, যদি কেউ শাসকের অঙ্গুলিহেলনে তাঁদের ইচ্ছামতো কাজ করতে সম্মত না হন?
উত্তর খুব সহজ। কেরিয়ার শেষ হয়ে যায়।
থুড়ি, একটু ভুল হল। ওপরের বাক্যটায় লেখা উচিত ছিল, ‘কেরিয়ার শেষ হয়ে যায়। যদি না তিনি কিশোর কুমার হন।’
বেঁচে থাকলে আজ ৯৫ বছর বয়স হতো আভাসকুমার গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে কিশোরকুমারের। কাল রাতেই একটা ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলাম, ভারতবর্ষের সর্বকালের সেরা রকস্টারের নাম কিশোরকুমার। কেন লিখেছিলাম? স্রেফ দুর্দান্ত গায়ক ছিলেন বলে? অসাধারণ স্টেজ পারফর্মেন্স করতেন বলে? না। রকস্টার হতে গেলে কতগুলো শর্তপূরণ করতে হয়। শুধু আনকনভেনশনাল হওয়াটাই যথেষ্ট নয়। অফ দ্য স্টেজ তাঁর জীবনে এমন কিছু দৃষ্টান্ত তৈরি করে যেতে হয়, যাতে মালুম পড়ে এই লোকটার শিরদাঁড়াটা টনটনে। আচরণে ভণ্ডামি নেই।
এরপরে যেটা লিখব, সেটা এই প্রজন্মের কতজন জানেন, বলা শক্ত। একটু পুরনো লোকজন নিশ্চয়ই জানবে। বাংলার গর্ব, দেশের অহংকার এই কিশোরকুমারকেই নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। রেডিওতে তাঁর গাওয়া গান বাজানোই বন্ধ করে দিয়েছিল সরকার। কিশোরের অপরাধ? না, তিনি ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁদের রাজনৈতিক চালের ঘুঁটি হতে রাজি হননি।
সালটা ১৯৭৬, জানুয়ারি মাস। কিশোর তখন খ্যাতির মধ্যগগনে। এদিকে ইমার্জেন্সি পিরিয়ডে কঠোর দমননীতির জন্য ইন্দিরা গান্ধীর সরকার সমালোচনায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। এমন সময় সরকারের ভাবমূর্তি ফেরানোর জন্য কিশোরকুমারকে ব্যবহারের কথা এল কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের মাথায়। কী করা হবে? না, কিশোরকে যুব কংগ্রেসের একটি মিছিলে হাঁটানো হবে।
একে কিশোর ইন্দিরার পুত্র সঞ্জয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তার ওপরে কণ্ঠদানের অনুরোধ যাবে খোদ সরকারের পক্ষ থেকে। অতএব না বলার প্রশ্নই ওঠে না। এদিকে কিশোরের মতো তারকা যদি কংগ্রেসের মিছিলে হাঁটেন, তাহলে সরকারের ভাবমূর্তি অনেকটাই উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
কিশোর কিন্তু সটান না–ই বললেন। কণ্ঠ দিতে রাজি হলেন না। বন্ধু সঞ্জয় গান্ধী রীতিমতো অনুনয়–বিনয় করলেন। তবু কিশোরের মত পাল্টাল না। কংগ্রেসের মাথারা ভাবলেন, যুব কংগ্রেস বলেই হয়তো কিশোরের আপত্তি হচ্ছে। ওঁকে আরও একটু ওজনদার কর্মসূচির প্রস্তাব দেওয়া যাক। তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী বিদ্যাচরণ শুক্লা কংগ্রেসের পক্ষে ২০ দফা কর্মসূচিতে কিশোরকে অংশ নিতে অনুরোধ করলেন।
কিশোরের উত্তর ‘না’।
তখন ঠিক হল, বেশ কিশোরকে মিছিলেও হাঁটতে হবে না, দলীয় কর্মসূচিতেও অংশ নিতে হবে না। কর্মসূচির জন্য যে গানটা বানানো হচ্ছে, সেটা ওঁকে দিয়ে গাওয়ানো যাক।
ফের কিশোরের উত্তর ‘না’।
১৯৭৬ সালের ৪ মে। দূরদর্শন এবং অল ইন্ডিয়া রেডিওতে কিশোরের গান বাজানোর ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেওয়া হল। এমনকী, যে সব গান তিনি আগে থেকে রেকর্ড করে রেখেছিলেন, সেগুলোর ওপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি হল। তবুও কিশোর একবারের জন্য কংগ্রেসের দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নেননি বা ওই কর্মসূচির গানটি গাইতে রাজি হননি। ১৯৭৭ সালে ইমার্জেন্সি যখন শেষ হল, তারপরে কিশোরের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা ওঠে।’
শুধুই কি রাজনৈতিক কারণ? শাসকের ঔদ্ধত্যও বোধহয় আঘাত দিয়েছিল কিশোরের আত্মসম্মানে। ১৯৮৬ সালে কিংবদন্তী সাংবাদিক প্রীতিশ নন্দীকে একটি সাক্ষাৎকারে কিশোর খোলামেলাভাবে জানিয়েছিলেন সেদিনের কথা। বলেছিলেন, ‘আমাকে দিল্লী থেকে ট্রাঙ্ককল করে বলা হয়েছিল, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের অফিস থেকে বলছি, আপনাকে দিল্লীতে এসে অনুষ্ঠান করতে হবে। উত্তরে আমি বলেছিলাম, আমার সেক্রেটারির সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলে নেবেন। ওঁর আচরণে প্রচণ্ড ঔদ্ধত্য ছিল। আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমাকে দিয়ে কেউ কোনও কাজ করাতে পারে না।’
যে কিশোরের গলার জাদুতে আসমুদ্রহিমাচল বুঁদ হয়েছিল, যিনি দু’লাইন গেয়ে দিলে সরকার সম্পর্কে গোটা দেশের মানুষের মানসিকতা পাল্টে যেতে পারত, সেই কিশোর যে শুরুর দিকে গান গাইতে মোটে ভালবাসতেন না, সেটাও অনেকের জানা। এমনকী, কোনও দিন গানের তালিমও নেননি তিনি।
কিন্তু কেন? কিশোরের বড় দাদা আর এক কিংবদন্তি অভিনেতা অশোককুমার ফাঁস করেছিলেন সেই রহস্যটা। শৈশবে কিশোরের গলা নাকি একদম ভাল ছিল না। একদিন দুষ্টুমি করতে গিয়ে পায়ে আঘাত পান কিশোর। তারপর নাকি তিনচারদিন একটানা নানারকম সুরে কান্নাকাটি করেছিলেন। তারপর কী যে হল, হঠাৎ করেই কিশোরের গলায় সুর চলে আসে। তখনও কিশোরের ধ্যানজ্ঞান শুধুই অভিনয়। অভিনয়ের সুবাদে নিজের গলায় গাইতেন তিনি। আর মাঝেমাঝে দেব আনন্দের লিপেও তাঁকে গাইতে দেখা যেত। ১৯৬৮ সালের আগে পর্যন্ত কিশোর নিজের বা দেব আনন্দ বাদে আর কারও জন্য গাননি। এদিকে বলিউডে তখন চলছে মহম্মদ রফির রাজত্ব।
১৯৬৫ সাল থেকে কিশোরের অভিনয় জগতে গ্রহণযোগ্যতা কমতে থাকে। ছবি ফ্লপ করছে, কাজ পাচ্ছেন না। খানিকটা বাধ্য হয়েই স্টেজ শো করতে শুরু করলেন তিনি। ১৯৬৯ সালে রিলিজ করল আরাধনা। সঙ্গীত পরিচালক শচীন দেববর্মন। জোর করেই কিশোরকে প্লে–ব্যাকে নিয়ে এলেন তিনি। আরাধনার প্রতিটা গান সুপারডুপার হিট। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। বলিউডের প্লে–ব্যাক সাম্রাজ্য স্পষ্টতই দু’ভাগ হয়ে গেল। এক ভাগের সম্রাট মহম্মদ রফি তো আর একভাগের সম্রাট কিশোরকুমার।
কয়েকবছরের মধ্যে এমন অবস্থা হল, বিখ্যাত ম্যাগাজিন ফিল্মিস্তান–এ নিয়মিত রফি বনাম কিশোর তুলনা করে লেখালিখি শুরু হয়ে গেল। কে বড়, রফি না কিশোর? বিনীত কিশোর নিজে সেই পত্রিকার সম্পাদককে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করলেন, এই বিষয়ে যেন আর লেখালিখি না করা হয়। মহম্মদ রফি তাঁর চেয়ে অনেক বড় শিল্পী। কিশোর কোনওদিন রফির মতো করে তাঁর গানগুলো গাইতেই পারবেন না। তাঁর সেই তালিমই নেই।
কখনও অপমান ভুলতেন না কিশোর। তাঁর পাগলামির অনেক গল্পই আছে। তবে যেহেতু এই ব্লগের শুরুটাই ‘না’ দিয়ে হয়েছে, তাই শেষটাও করি কিশোরের আর একটা না বলার গল্প দিয়েই। একটা সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে ঘটনাটা বলেছিলেন জাভেদ আখতার।
কিশোরকে যে পরিচালক অথবা প্রযোজককে ফিরিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের কখনও ভুলতেন না তিনি। এমনই এক পরিচালক, যিনি অতীতে কিশোরকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, পরে এসেছেন কিশোরের কাছে। তাঁকে দিয়ে একটা গান গাওয়াতে চান। কিশোর এঁদের সরাসরি মুখের ওপরে না বলতেন না। এই পরিচালককে কিশোর বলেছিলেন, গান গাইবেন। কোনও আপত্তি নেই। তবে এই চুক্তি সই বাড়িতে হবে না। হবে গঙ্গার ধারে। সেখানে দুটো নৌকা পাশাপাশি রাখা থাকবে। সেখানে তারা দু’জন ধুতি-পাঞ্জাবি পরে যাবেন। কপালে লাল ফোঁটা আর এবং সেই ফোঁটার উপর একটি চাল বসানো থাকবে। এভাবে সেই নৌকার উপর দাঁড়িয়ে তিনি চুক্তিতে সই করবেন! বলাই বাহুল্য, সেই চুক্তি আর সই হয়নি।
৪০ বছরের কেরিয়ার। দু’হাজারের বেশি গান। একটা সিগনেচার টোন! কী সেই সিগনেচার টোন?
না, ইয়ডলিং!
ইয়ডলিং শব্দটা অনেকেই চট করে বুঝতে পারবেন না। সহজ করে বুঝিয়ে বলতে গেলে, গান গাইতে গাইতে লো পিচ থেকে আচমকা হাই পিচে উঠে যাওয়া। যা কি না কিশোরকুমারের সিগনেচার ছিল। ‘পাঁচ রুপাইয়া বারা আনা’, ‘চলা যাতা হুঁ, কিসি কে ধুন মে’, ‘থোড়ি সি জো পি লি হ্যায়, চোরি তো নহি কি হ্যায়’, ‘ইয়ে দিল না হোতা বেচারা’— এরকম অগণিত হিট গানে কিশোর ইয়ডলিং ব্যবহার করেছেন। রোম্যান্টিক বা একটু মজাদার গানগুলিতে মূলত কিশোর এই স্টাইল ব্যবহার করেছেন।
কোথা থেকে কিশোর শিখলেন এই স্টাইল? কীভাবেই বা শিখলেন?
মূলত ইয়ডলিং হল পাশ্চাত্যের কান্ট্রি মিউজিকের একটা স্টাইল। কিশোরই যে ইয়ডলিং ভারতীয় গানে প্রথমবার ব্যবহার করেন, তার সাক্ষ্য দিয়েছেন আশা ভোঁসলে স্বয়ং। কিশোরের ভাই অনুপ কুমার জানিয়েছিলেন, একদিন তিনি জিমি রজার্সের ‘রক অল আওর বেবিজ টু স্লিপ’ গানের রেকর্ডটা চালিয়ে ছিলেন। কিশোর সেই সময় সেই ঘর লাগোয়া বাথরুমে স্নানে ঢুকেছিলেন। স্নান করতে করতেই ইয়ডলিং শিখে ফেলেন কিশোর।
পরে শচীনদেব বর্মনকে খেলার ছলেই ইয়ডলিং করে শুনিয়েছিলেন কিশোর। শোনামাত্র শচীনকত্তা নড়েচড়ে বসলেন। বললেন, কিশোর যেন এই স্টাইলটা গানে ব্যবহার করেন।
তর্কযোগ্যভাবে শুধু ভারতবর্ষেরই নয় গোটা উপমহাদেশের জনপ্রিয়তম গায়ক কিশোরকুমার। অথচ এই লোকটারই নাকি ছিল স্টেজফোবিয়া! সামনে বেশি লোক দেখলে নাকি ভেবলে যেতেন!
নিয়তি যে কার কপালে কী লিখে রাখে!