ধরুন আপনার আর কিচ্ছু ভাল লাগছে না। বন্ধু–কলিগ–আত্মীয়–পরিবার–পরিজন সব কিছুই বিষময় লাগছে। মনে হচ্ছে, ‘ধুত্তেরি, সব ছেড়েছুড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে পারলে ভাল হতো’।
হয় না এরকম? হয়। আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আটকা পড়ে যাই। তার জন্য শুধুই যে আমাদের পিছুটান দায়ী, তা নয়। একথাও আমাদের মাথায় আসে, নতুন যদি কোথাও গিয়ে থাকতে শুরুও করি, তাহলে বেঁচে থাকার জন্য অর্থের জোগানটা আসবে কোথা থেকে? থাকব কোথায়? খাব কী?
জীবন এবং পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়ে গিয়ে সব ছেড়ে অন্যত্র একা থাকতে চাইছেন, এমন মানুষদের কিন্তু জাপানে একটা বিশেষ নাম আছে। তাদের বলে জুহাতসু! জুহাৎসু শব্দের অর্থ বাষ্পের মতো উবে যাওয়া।
যদি কখনও জানতে পারেন, জুহাৎজুদের হেল্প করার জন্য রয়েছে কিছু পেশাদার সংস্থা, তাহলে চমকে যাবেন তো? একটা–দুটো নয়, জাপানে কিন্তু এমন শ’য়ে–শ’য়ে সংস্থা গড়ে উঠেছে। যাদের কাজ জুহাৎজুদের নতুন জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে দিতে সাহায্য করা।
কী করে এই সংগঠনগুলো? ধরুন রামবাবু একজন জুহাৎজু। তিনি সব ছেড়েছুড়ে একা নতুন করে জীবনযাপন করতে চাইছেন। রামবাবু এমবিএ করেছেন। একটি কোম্পানিতে তিনি সেল্সে কাজও করতেন। এবার তিনি সহযোগিতা চাইলেন জুহাৎজুদের হেল্প করে এমন একটি সংগঠনের। ওই সংগঠন কী করবে? রামবাবুর নাম পাল্টানো থেকে শুরু করে, তাঁকে বহুদূরের শহরে একটি কোম্পানিতে কর্মখালির খোঁজও দেবে। যদি রামবাবু চাকরি পেয়ে যান, তাহলে যেখানে তাঁর পোস্টিং হবে, তার আশপাশে তাঁকে ঘরও খুঁজে দেবে।
অবশ্যই এসবের জন্য তারা একটা মোটা টাকা পারিশ্রমিকও নেবে।
ধরে নিন রামবাবু আগে টোকিওতে থাকতেন। এখন তিনি থাকেন ওসাকাতে। তাঁর নতুন নাম হয়েছে শ্যামবাবু। সংগঠনের কাছে এর পুরো ডেটাবেস থাকে। কিন্তু একমাত্র যিনি নিজেকে বাকিদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে চাইছেন, তাঁর নামে কোনও অপরাধমূলক কাজের অভিযোগ না থাকলে, সেই ডেটাবেস তারা কারও কাছে ফাঁস করে না।
জাপানে এভাবে হঠাৎ করে জুহাৎজু হয়ে যাওয়ার চলটা শুরু হয়েছে ১৯৬০–এর পর থেকে। দীর্ঘদিন ধরে হিরোকি নাকামোরি নামে এক বিজ্ঞানী জুহাৎজুদের নিয়ে গবেষণা করছেন। বিবিসি–কে দেওয়া একটা সাক্ষাৎকারে দারুণ ইন্টারেস্টিং কয়েকটা তথ্য তিনি জানিয়েছেন। তাঁর মতে, অপরাধ করে লুকিয়ে পড়ার জন্য আজকাল আর কেউ জুহাৎজু হয় না বললেই চলে। কারণ, কে কোথায় গা ঢাকা দিচ্ছে, তার ডিটেইলড তথ্য কোনও কোম্পানির হাতে থাকুক, এটা কোনও অপরাধীই চায় না। বরং সবচেয়ে বেশি জুহাৎজু হতে চান বিবাহিত পুরুষরাই। প্রেমহীন বিয়ে জাপানে একটা বিরাট বড় সমস্যা। ডিভোর্সের হার জাপানে খুব কম। বিবাহবিচ্ছেদের চেয়ে বোধহয় জুহাৎজু হয়ে যাওয়াকেই বেছে নেন বিয়ের ফাঁসে আটকে পড়া নারী–পুরুষরা।
নাকামোরি বলছেন, ‘প্রেম–বিবাহঘটিত সমস্যা এবং জীবন সম্পর্কে বিতৃষ্ণা— এই দুটো কারণেই সবচেয়ে বেশি মানুষ জুহাৎজু হচ্ছেন। তাঁদের সংখ্যাটা এতটাই বেশি যে এঁদের পরিষেবা দিয়ে অগণিত কোম্পানিও চলছে গোটা দেশে।’
অবশ্য জাপান সরকারের আইন জুহাৎজুদের ‘সাহায্য’ করে অনেকভাবে। এদেশে মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কঠোরভাবে রক্ষা করা হয়। নিখোঁজ ব্যক্তিরা তাঁদের পরিচয় না দিয়েও এটিএম থেকে টাকা তুলতে পারেন। এছাড়াও পালিয়ে যাওয়া এই ব্যক্তি যদি গোপন ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোনও ক্যামেরাতে ধরাও পড়েন, তার পরিবারের সদস্যদের ওই ভিডিও দেখতে দেওয়া হয় না। ফলে আমার পরিবারের সদস্য কোথায় গিয়ে লুকিয়ে আছেন, সেটা জানার জন্য যদি কেউ ফেলু মিত্তিরদের দ্বারস্থও হন, সেক্ষেত্রেও দিনের শেষে ‘হিসেব মিলছে না রে তোপসে, হিসেব মিলছে না’ বলা ছাড়া বিশেষ কিছু করার থাকে না। কোনও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যদি স্বেচ্ছায় জুহাৎজু হয়ে যান, তাহলে জাপান পুলিস সেক্ষেত্রে বিশেষ নাক গলায় না।
কেউই বোধহয় চাইবেন না, তাঁর পরিবারের কোনও সদস্য হঠাৎ করে একদিন নিখোঁজ হয়ে যাবেন। যাঁদের পরিবারের সদস্যরা এরকম দুম করে জুহাৎজু হয়ে যান, তাঁদের বাকি জীবনটা যে অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্যে কাটে, সেটা বলাই বাহুল্য। আর যাঁরা সব ছেড়ে চলে যান, তাঁরা? শেষ করি, তাঁদেরই একজনের কথা দিয়ে।
মহিলার নাম সাইতো। বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমি চাইলে আত্মহত্যা করতে পারতাম। জীবন আমার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। তবু আমি নতুন করে বাঁচতে শিখেছি। বাঁচছিও। আমি হয়তো সুখী নই, তবু যেভাবেই হোক, বেঁচে তো আছি।’
আত্মহত্যা না করে একটা মানুষ বাঁচতে শিখছে। এটাই বা কম কী বলুন তো? তাছাড়া জীবনের কোনও না কোনও মুহূর্তে অন্তত একবার জুহাৎজু আমরা কে না হতে চেয়েছি! নেহাত সাহসে কুলোয়নি বলে পারিনি।
