এই যে মন্দারমণি চলে এলাম টুক করে, গাড়ির জানলার পাশে হাওয়া খেতে খেতে একটা বিচিত্র প্রশ্ন মনে এল। আচ্ছা, আমরা ট্যুরিস্ট স্পটগুলোর ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামাই না কেন? বেনারস কিংবা দিল্লীর মতো বহু পুরনো শহরগুলোর ইতিহাস বহুলচর্চিত। কিন্তু এই দিঘা–দার্জিলিং নিয়ে সেভাবে লেখালিখি হয়নি কখনও। খুঁজতে খুঁজতে যা দেখতে পেলাম, সেটা বেশ চমকে দেওয়ার মতো। পাণ্ডববর্জিত গ্রাম থেকে ঝাঁ চকচকে ট্যুরিস্ট স্পট হয়ে ওঠার যে সফরটা সেটা কিন্তু মন্দারমণির শুরু হয়েছিল আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের হাত ধরে। আর মন্দারমণি নামটা নাকি পর্যটকদের মৌখিক অপভ্রংশের থেকে এসেছে। আর আজকের যে মন্দারমণি আমরা দেখি, তার পিছনে রয়েছে দুই বাঙালি ব্যবসায়ীর উদ্যোগ!
দিঘা যাওয়ার পথে রামনগর ২ ব্লকের চালখোলা থেকে ডানদিকে ১২ কিলোমিটার এগোলেই মন্দারমণি। যার আসল নাম মান্দারবণি বা মান্দার গাছের বন। কেন? না, জনমানবহীন সমুদ্র তীরে লাল কাঁকড়ার ভিড় আর মান্দার গাছের লাল ফুলের খুনখারাপি কম্বিনেশন। ধীরে ধীরে ট্যুরিস্ট আসা শুরু হল। মান্দারবণি বা মাদারবণি পরিচিত হল মন্দারমণি নামে।
এতো গেল একটা গল্প। রোসো, মন্দারমণির নামকরণ নিয়ে গল্প আরও আছে। যাঁরা পূর্ণিমার সন্ধ্যায় মন্দারমণির বিচে হেঁটেছেন, তাঁরা জানেন, তখন দৃশ্যটা সত্যিই অপূর্ব। চাঁদের আলোয় সি বিচের বালি চিকচিক করে। এ–ও শোনা যায়, চন্দ্রালোকে বালির ঝিকিমিকি নাকি মণির ওপরে আলো পড়ে ঝলমল করার মতোই দেখায়। সেই থেকেই নাম মন্দারমণি। আবার এও শোনা যায়, ব্রিটিশ আমলে কোনও এক ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর নাকি এখানের সি বিচে রাশিরাশি সন্ন্যাসী কাঁকড়ার পাল বেঁধে দৌড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে মনে করেছিলেন হাওয়ার ধাক্কায় রাশিরাশি লাল মান্দারফুল উড়ে যাচ্ছে। তিনিই নাকি নাম রাখেন মন্দারমণি। তবে যে যাই বলুক, ওই মান্দারের ঝোপ থেকে মান্দারবনি থিওরিটাই বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়।
বছর পঁচিশেক আগেও হাতের কাছে দিঘায় যখন জমজমাট ভিড়, তখন মন্দারমণি ধূধূ ফাঁকা। পর্যটন শিল্পের নামগন্ধ নেই। জীবিকা বলতে মাছধরা চাষ আর লঙ্কা–তরমুজ–মুলোর মতো টুকটাক শস্য চাষ। অথচ মন্দারমণি হতেই পারত আর একটা জুনপুট কিংবা হলদিয়া। কারণ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের উদ্যোগে ১৯৩০ সালের শেষের দিকে তিরিশের দশকের শেষ দিকে মন্দারমণির কাছে দাদনপাত্রবাড়ে বেঙ্গল সল্ট কোম্পানি লিমিটেড নাম দিয়ে রাজ্যের বৃহত্তম লবণ কারখানা তৈরি হয়েছিল। ২০০০ সাল থেকেই অবশ্য সেই কারখানার ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
এদিকে আসল কাজের কাজটা করেছিলেন (যাঁদের নাম কোথাও পাওয়া যায় না) বালিসাইয়ের দেবদুলাল দাসমহাপাত্র এবং কোলাঘাটের সুশীল বেরা। স্থানীয় মানুষরা এঁদের আধুনিক মন্দারমণির জনক বলে মনে করেন। ন’য়ের দশকের মাঝামাঝি মন্দারমণিতে এসে সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় পুকুর কেটে বাগদা চিংড়ি চাষ শুরু করলেন এই দু’জন। চাষ ক্রমে জমে উঠল। ব্যবসা বড় হল। জনহীন এলাকায় বাগদা চাষের ভেড়ি পাহারা দেওয়া ও নিজেদের থাকার জন্য সুশীলবাবু ভেড়ির পাড়েই ‘সমুদ্র বিলাস’ নাম দিয়ে কাঠের পাটাতন দিয়ে ছোট ছোট কয়েকটি ঘর বানান। সেখানে আসাযাওয়া শুরু হল সুশীলবাবু ও দেবদুলালবাবুর আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবদের। মুখে মুখে রটে গেল, অপূর্ব সুন্দর এই সৈকতের কথা। কিন্তু তখনও এখানে থাকার জায়গা নেই।
কে বলে বাঙালি ব্যবসা দেখতে পায় না? দেবদুলালবাবু কিন্তু বুঝলেন, এখানে হোটেল ব্যবসা জমে উঠবে। বাগদা চাষের পাশাপাশি নতুন লজ বা হোটেল তৈরি করতে এগিয়ে দেবদুলাল দাসমহাপাত্র। তৈরি করলেন ‘তরঙ্গমালা’। এটাই মন্দারমণির প্রথম হোটেল।
২০১১ সালে বাম সরকারের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতায় এল তৃণমূল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিঘার ওপরে একেবারে স্পটলাইট ফেললেন। সেই আলোয় খানিক ঝকমক করে উঠল মন্দারমণিও। এখন মন্দারমণিতে হোটেলের সংখ্যা একশোর বেশি বলেই মনে করেন স্থানীয়রা। দিঘার সঙ্গে মন্দারমণির মূলগত ফারাকটা হল, মন্দারমণিতে প্রায় সব হোটেলই একেবারে সমুদ্রের গায়ে লাগা। শুনলাম, ব্যাপারটা নাকি বিপজ্জনক এবং নিয়মবিরোধী। স্থানীয় বাসিন্দাদের সেটা নিয়ে একটু উষ্মা আছে বটে। তবে সেই গজগজানি পর্যটকদের হুল্লোড়ে অতলে তলিয়ে গেছে।
একেবারে ঠিক হিসাবটা অবশ্য সরকারই বলতে পারবে। তবে হোটেল যাই হোক, যাতায়াত নিয়ে সমস্যাটা কিন্তু থেকেই গেছে।
কিন্তু মান্দারের গাছ? তার লাল ফুল? যার থেকে নাম মন্দারমণির! সেগুলো গেল কোথায়?
উন্নয়ন হবে আর তার মাশুল দেওয়া হবে না, তা কি হয়? সি বিচ এখন বিয়ারের বোতলে উপচে পড়েছে যে।
