একজন সলমন খানের ভক্ত, সাউথ ইন্ডিয়ান হুড়ুমদারুম অ্যাকশন ফিল্মের ভক্ত যখন ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে (অফিস টাইম ধরা আছে এই ২৪ ঘণ্টায়) কোনও ‘নিরামিষ’ সিরিজ শেষ করে, তখন সেই সিরিজের নাম ‘পঞ্চায়েত’ না হয়ে যায় না।
সানি লিওনির কোমর দোলানো আইটেম নাম্বার লাগে না, ফ্রন্টাল ন্যুডিটির ঝলক লাগে না, কারণে–অকারণে রগরগে যৌনতার আচার লাগে না— তবু পঞ্চায়েত ২ বুঁদ করে রাখল। আমরা কথায় কথায় তুলনা টেনে বলি, ‘আহা বলিউডের বাজেট অনেক বেশি, তাই ওরা ওরকম বানাতে পারে।’ রাখুন তো, পঞ্চায়েত ২–তে কৌনসা সঞ্জয় লীলা বনশালীর সেট আর রাজামৌলীর স্টারকাস্ট ইউজ করা হয়েছে। উত্তরপ্রদেশের বালিয়া জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম, ভাঙাচোরা ধুলোওড়া রাস্তা আর ভীষণরকমের বিশ্বাসযোগ্য কাস্টিং দিয়ে যে এমন রূপকথা বোনা যায়, তা কে জানত? আর গ্রামের বর্ণনার ডিটেইলিং এমন নিখুঁত, মনে হচ্ছিল যেন বিভূতিভূষণ স্বর্গ থেকে নেমে এসে হিন্দি ভাষায় কলম ধরে চিত্রনাট্য লিখে দিয়ে গেছেন।
পঞ্চায়েত ২ আসলে হতে হতেও না হওয়া রোম্যান্সের গল্প নয়, পঞ্চায়েত ২ আসলে এক ব্রোম্যান্সের গল্প। চার বন্ধু, অসমবয়সি বন্ধুর গল্প। এর আগে বলিউডে বন্ধুত্বের গল্প কম দেখিনি। কিন্তু সেসবই লার্জার দ্যান লাইফ। ‘রং দে বসন্তী’, ‘জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা’— এই ছবিগুলোতে সেই সব প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে গল্প সাজানো হয়েছে, যা মধ্যবিত্ত ভারতীয়রা জীবনে করার স্বপ্ন দেখে, কিন্তু করে উঠতে পারে না। আর এখানে একজন পঞ্চায়েত প্রধান (রঘুবীর যাদব), একজন পঞ্চায়েত সচিব (জীতেন্দ্র কুমার), একজন পঞ্চায়েত সহায়ক (চন্দন রায়) এবং একজন পঞ্চায়েত উপপ্রধান (ফৈজল মালিক)— চারজনেই চরম বাস্তব চরিত্র। তাঁদের কার্যকলাপ এবং জীবনের ঘটনাপ্রবাহ এমনই, যা যে কোনও দিন আমাদের সঙ্গেই ঘটে যেতে পারে।
মজার কথা হল, এই চারজনেই বন্ধু। তাঁরা একসঙ্গে কাজ করেন। পদমর্যাদার ফারাক ভুলে বিয়ার–পার্টি করেন। যে কোনও সমস্যায় একে অন্যের পাশে দাঁড়ান। আবার বন্ধুর অপমান দেখলে একটা সময়ের পরে গর্জেও ওঠেন। ‘রং দে বসন্তী’ কিংবা ‘জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা’–র মতো এঁদের সামাজিক, শিক্ষাগত কিংবা অর্থনৈতিক পরিস্থিতি প্রায় একরকম নয়। বরং ফারাক বিস্তর। এঁদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠাটা একটু অস্বাভাবিক। কিন্তু চিত্রনাট্যের বুনোট এমনই যে, এঁদের বন্ধুত্ব এক সেকেন্ডের জন্যও অস্বাভাবিক মনেই হয় না।
একটু আগে কাস্টিংয়ের প্রশংসা করছিলাম। এই সিরিজের অন্যতম সেরা আবিষ্কার পঞ্চায়েত সহায়ক চন্দন রায়। প্রথমে এই সিরিজে তাঁর অভিনয় করার কথা ছিল গ্রামবাসী হিসেবে একটা ছোট্ট রোলে। সেই রোলে অভিনয়ও নিশ্চিত ছিল না। কম গুরুত্বপূর্ণ রোল, পরে দেখা যাবে, অনেকটা এমন ভেবেই চন্দনের নাম স্রেফ খাতায় লিখে রেখেছিলেন পরিচালক দীপক কুমার মিশ্র। চন্দনের সঙ্গে আগে কাজ করার সুবাদে রঘুবীর যাদব জানতেন, ওঁর ক্ষমতা। খানিকটা তার জোরাজুরিতেই গ্রাম সহায়কের রোলে অডিশনে চন্দনকে ডাকেন দীপক। বাকিটা ইতিহাস।
আবার পঞ্চায়েত উপপ্রধানের ভূমিকায় ফৈজলের অভিনয়ের গল্পটা আবার উল্টো। ‘গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর’–খ্যাত ফৈজলের ক্যামেরার সামনে আসার ইচ্ছেই ছিল না। কিন্তু পরিচালক দীপকের জোরাজুরিতে তিনি অভিনয় করতে রাজি হন। স্পয়লার দেবো না। কিন্তু শেষ দুটো এপিসোডে ফৈজল কোন উচ্চতায় তুলে নিয়ে গেছেন নিজেকে, সেটা দেখলেই বোঝা যাবে।
শুধু কাস্টিং কেন, লোকেশনও এরকম অবিশ্বাস্য রকমের বাস্তবসম্মত কেন? ফুলেরা গ্রামের লোকেশন বাছার আগে বালিয়া জেলা এবং তার আশপাশের কম করে ৩০০ গ্রামে ঘুরেছেন পরিচালক। কিন্তু বহু গ্রাম ঘুরে ঘুরে যে লোকেশন পরিচালকের পছন্দ হল, তাতে পরিবহন ব্যবস্থা এবং রাস্তার অবস্থা এতটাই খারাপ যে ক্যামেরা, ক্রু–মেম্বার এবং অভিনেতাদের গাড়ির আসাযাওয়া করাটাই একটা বড় সমস্যা হয়ে উঠল! কী আর করা, ওই খারাপ রাস্তাকেই দেখালেন পরিচালক, গল্পও দিলেন সামান্য পাল্টে। শুধু তাই নয়, যাঁরা দেখেছেন, রাস্তার খারাপ হালকে এই গল্পের কত বড় গুরুত্বপূর্ণ ট্যুইস্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। পরিচালক দীপক হাতের কাছে যা পেয়েছেন, সেটাকেই নিজের উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। আর একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। একটা এপিসোডের শুরুতেই একজন ইলেকট্রিশিয়ানের ল্যাম্পপোস্টের ওপরে উঠে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানোর সিন আছে। ইলেক্ট্রিশিয়ানের ভূমিকায় অভিনেতা হিসেবে যে অভিনেতাকে নির্বাচন করা হয়েছিল, শেষ মুহূর্তে তাঁর চেহারা দেখে পরিচালক দীপকের মনে হয়েছিল, এঁকে ঠিক গ্রাম্য ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি বলে মনেই হচ্ছে না। দীপক নিজেই চটপট মেকআপ করে ওই ইলেক্ট্রিশিয়ানের ভূমিকায় অভিনয় করে দিয়েছেন!
বাজেট লাগে, একথা অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই। তবে বাজেটের পাশাপাশি দরকার উপস্থিত বুদ্ধি, সদিচ্ছা এবং অতি অবশ্যই ভাল গল্প।
পঞ্চায়েত এক সফল চারইয়ারি কথা। বাহুল্যবর্জিত। ন্যাকাপ্রেম বর্জিত। ধুন্ধুমার অ্যাকশন বর্জিত।
অথচ কী প্রচণ্ড স্মার্ট, কী নিদারুণ হৃদয়স্পর্শী, কী গভীর।
এরকম সিরিজ বাংলায় হলে লোক ডেকে ডেকে বলতে হবে না। লোকে এমনিই পাশে দাঁড়াবে।