সাংবাদিক সবে প্রশ্নটা করেছিলেন, ‘আপনার সিনেমা যখন হিট হয়, মানুষ আপনাকে ভালবাসা দেন...’
প্রশ্ন শেষ করার আগেই উত্তর ছুটে এল, ‘সিনেমা হিট না হলেও মানুষ আমাকে ভালবাসাই দেন।’
এই হলেন শাহরুখ খান! তাঁর ছবি হিট করল নাকি ফ্লপ, সেটা কোনও ব্যাপারই নয়। শাহরুখের নামটাই কাফি। ভারত তো বটেই, গোটা বিশ্বে যেখানে যেখানে বলিউড, সেখানেই শাহরুখ খান। সাময়িক ব্যর্থতা হয়তো তাঁর সমালোচকদের কিছুটা সুবিধা করে দিয়েছিল, কিন্তু ‘পাঠান’–এর আকাশছোঁয়া সাফল্য প্রমাণ করে দিয়েছে শাহরুখ এবং তাঁর ক্যারিশমা ‘জিন্দা হ্যায়’।
কিন্তু বলিউডের তিনখানের মধ্যের কেন শাহরুখকে ঘিরে পাগলামি সবচেয়ে বেশি? বিশেষত কেন মহিলা দর্শকরা শাহরুখ বলতে অজ্ঞান? ৫৭ বছর বয়সেও কেন শাহরুখ বাড়িয়ে দিতে পারেন যে কোনও নারীর হৃদস্পন্দন? নিছকই ক্যারিশমা নাকি এর পিছনেও রয়েছে কোনও কৌশল? সেটাই আজ খতিয়ে দেখব আমরা।
সিক্স প্যাক হালে বানিয়েছেন শাহরুখ। এই সেদিনের ‘ওম শান্তি ওম’–এর সময়, যা কি না ২০০৭ সালে মুক্তি পেয়েছিল। এদিকে শাহরুখের বলিউডে আত্মপ্রকাশ ১৯৯২ সালে। শুরুর দিকে বাজিগর কিংবা ডর–এ অ্যান্টি হিরোর রোল করেও ধীরে ধীরে মহিলাভক্তদের চোখের মণি হতে শুরু করেন শাহরুখ। তারপরে একে একে ‘ইয়েস বস’, ‘দিল তো পাগল হ্যায়’, ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’, ‘পরদেশ’ থেকে পাকাপাকিভাবে শাহরুখের গায়ে লেগে গেল রোম্যান্টিক হিরোর তকমা। মহিলা ভক্তদের কাছে তিনিই হয়ে উঠলেন রোম্যান্সের শেষ কথা।
কিন্তু কীভাবে? শাহরুখের নিজের কথাতেই বলি, ‘হ্যান্ডসাম বলতে যা বোঝায়, তা আমি ছিলাম না। আমার চুল ছিল ভাল্লুকের লোমের মতো। এমনকী, দারুণ পেশিবহুল শরীরও আমার ছিল না। আমার মা বাদে কেউ বিশ্বাসই করতো না আমি এই চেহারা নিয়ে অভিনেতা হতে পারি, রোম্যান্টিক হিরো হওয়া তো দূর কি বাত।’
শাহরুখ যা বলেননি, তা হল সূক্ষ্ম কিছু মার্কেটিংয়ের কারিকুরি। খেয়াল করলে দেখা যাবে, শাহরুখের প্রায় প্রতিটা সিনেমাতেই অন্তত এমন একটা দৃশ্য থাকে, যেখানে তিনি রান্না করছেন কিংবা কোনও মহিলা চরিত্রকে রান্না কিংবা ঘরের কাজ করতে সহযোগিতা করছেন। শাহরুখের প্রায় যে কোনও হিট ফিল্মেই পরিবারের মহিলাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেজাজে সুখদুঃখের গল্প করতেও দেখা যায়। এর বাইরে যে কোনও শিশু চরিত্রের সঙ্গেই স্নেহপ্রবণ আচরণ করতেও দেখা যায় তাঁকে। বিশেষ করে এমন দৃশ্য তো থাকতেই হবে, যেখানে মহিলা চরিত্রদের প্রতি শাহরুখ ‘প্রোটেক্টিভ আচরণ করছেন’! বলিউডের গসিপে কান পাতলে শোনা যায়, চিত্রনাট্যে না থাকলেও মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্যভাবে চিত্রনাট্যকারদের এই ধরনের দৃশ্য এবং সংলাপ ঢুকিয়ে দিতে অনুরোধ করেন শাহরুখ। ফলে মহিলা দর্শকদের কাছে শাহরুখ হয়ে ওঠেন কেয়ারিং, ভরসাযোগ্য বিশ্বাসের উপযুক্ত এক চরিত্র।
আরও কেন জনপ্রিয় তিনি? প্রায় প্রতিটি ফিল্মেই শাহরুখ এমন কোনও চরিত্র বেছেছেন, যিনি ফিল্মের নারী চরিত্রের প্রতি প্যাশনেট। এই প্যাশন পজিটিভও হতে পারে, নেগেটিভও হতে পারে। কিন্তু নারীচরিত্রকে গুরুত্ব দিয়ে করে ঘোরাফেরা করেছে শাহরুখের গতিবিধি। তা সে ‘স্বদেশ’–এর ধাইমা হন, কভি আলবিদা না কহেনার পরকীয়া প্রেমিকা হন, কাল হো না হো–র না পাওয়া প্রেমিকা হন কিংবা কুছ কুছ হোতা হ্যায়–এর অতীত প্রেমিকা হন— শাহরুখের ছবিতে সাধারণত নারীচরিত্রকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়। নেহাত আইক্যান্ডি করে রেখে দেওয়া হয় না।
শাহরুখ তাঁর ফিল্মের চরিত্রও বেছে নেন খুব সন্তর্পণে। এই চরিত্র বাছা তাঁকে তাঁর ইমেজ ধরে রাখতে সাহায্য করে। অন্য হিরোদের মতো শাহরুখ সব দিক থেকে নিখুঁত সাজার চেষ্টা করেন না। তাঁর চরিত্রগুলোতে প্রায়শই কোনও না কোনও দুর্বলতা দেখা যায়। তা সে ‘রাজু বন গয়া জেন্টেলম্যান’–এর অতি উচ্চাকাঙ্খী যুবক হোক কিংবা বাজিগরের প্রতিশোধস্পৃহায় বুঁদ থাকা নায়ক কিংবা , যার মধ্যে অগণিত দুর্বলতা রয়েছে। কখনও দুর্বল প্রেমিক, কখনও দুর্বল নায়ক, কখনও দুর্বল স্বামী এমনকী দোর্দণ্ডপ্রতাপ নয়, খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করলেও তার নানা দুর্বলতার দিকে উঠে এসেছে। নারীমন স্বভাবতই স্নেহপ্রবণ। দুর্বলদের দিকে তা সহজেই ঝুঁকে পড়ে। শাহরুখ অভিনীত চরিত্রগুলোকেও তাই তাঁরা ভালবেসে ফেলেছেন।
শুধুই কি ফিল্মের দৃশ্য কিংবা চরিত্র? না, শাহরুখ আসলে লার্জার দ্যান লাইফ এক চরিত্র, যিনি নারীদের সমান সম্মান দিকে জানেন। তাই রিল হোক বা রিয়েল লাইফ খুব সচেতনভাবেই এই ইমেজটা বহন করেন। কেমন? একটা উদাহরণ দিয়ে দেখা যাক। শাহরুখকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনি তো একজন মুসলিম। হিন্দু হলে আপনার নামের এস এবং কে বজায় রেখে আপনার নাম কী হতো? শেখর রাধাকৃষ্ণ?’ শাহরুখ তৎক্ষণাৎ ওই সাংবাদিককে শুধরে দিয়ে বলেন, ‘আমার নামের আদ্যাক্ষর এস এবং পদবির আদ্যাক্ষর কে হলেও, আমি পরিচিত এসআরকে নামে। তাই ওটা শেখর রাধাকৃষ্ণ হবে। আমাদের দেশে রাধা ও কৃষ্ণের নাম একসঙ্গেই উচ্চারিত হয়।’
অর্থাৎ শুধু পুরুষ নয়, নারীচরিত্রকেও সমানভাবে স্বীকৃতি— এরপরেও মহিলারা শাহরুখের ফ্যান হবেন না তো কার ফ্যান হবেন? এছাড়াও সহঅভিনেত্রীদের এতটাই সম্মান দেন শাহরুখ যে পরিচালকদের তিনি অনুরোধও করেন যাতে সিনেমায় তাঁর আগে নায়িকাদের নাম দেখানো হয়।
কেন নারীদের মধ্যে শাহরুখ এত জনপ্রিয়? উত্তর খুঁজতে ২০ বছর ধরে গবেষণা করে একটি বই লিখেছেন শ্রায়াণা ভট্টাচার্য। হার্পার কলিন্স থেকে প্রকাশিত বইটির নাম ছিল, ‘ Desperately Seeking Shah Rukh’। বইটি লেখার আগে শাহরুখের হাজার হাজার মহিলা ভক্তের সঙ্গে কথা বলেছিলেন শ্রায়াণা। তিনি লিখছেন, পর্দায় আবেগ প্রকাশ করতে গিয়ে শাহরুখ যেভাবে অনেক সময় বেসামাল হয়ে হুহু করে কাঁদেন, যেটা বলিউডে বেশ বিরল, তা পছন্দ করেন নারীরা। মর্দ কো দর্দ নেহি হোতা, এই ছিল বলিউডের একসময়ের হিরোইজমের ফর্মুলা। সে সব হিরো চরিত্রদের দূরে সরিয়ে ছলছল চোখে নিজের আবেগ প্রকাশ করে ফেলা শাহরুখ কখন যে নারীদের কাছের মানুষ হয়ে উঠলেন, তা আমরা কেউই খেয়াল করিনি। শ্রায়াণাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যেমন ধনী পরিবারের অসুখী বিবাহিতা এক নারী জানান, তিনি তার ছেলেদের ‘ভাল মানুষ‘ হিসেবে বড় করতে চান। তার কাছে ভালো মানুষের সংজ্ঞা, তারা যেন কাঁদতে পারে, শাহরুখ যেমন আমাদের মধ্যে যে ভরসা এবং ভালোবাসার বোধ তৈরি করে, তার ছেলেরাও যেন তাদের স্ত্রীদের মনে একই অনুভূতি তৈরি করতে পারে।
একটু আগেই বলেছিলাম রান্নাবান্নার দৃশ্যে বাড়ির মহিলাদের সঙ্গে শাহরুখের সাহায্য করার কথা। শ্রায়াণার বইতে এরও উদাহরণ পাওয়া যায়। তিনি লিখছেন, ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে ছবি সম্পর্কে শাহরুখের এক তরুণী ফ্যানের মা আমাকে যে কথা বলেন তা আমি কখনও ভাবিনি, লক্ষ্যও করিনি, ‘আমি প্রথমবারের মতো ওই ছবিতে দেখলাম নায়ক ছুরি দিয়ে গাজর কাটছেন। পরিবারের নারীদের সঙ্গে নায়কের এত হৈচৈ, এত সময় কাটানোর ব্যাপার আমি আগে কোনও সিনেমায় দেখিনি। ব্যাপারটা দারুণ রোম্যান্টিক না?’
মহিলাদের মধ্যে শাহরুখের জনপ্রিয়তার আর এক কারণ তাঁর সেন্স অফ হিউমর। শাহরুখ তখন মুম্বইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে মারামারি করে খবরের শিরোনামে। তার কয়েকদিন পরে কলকাতায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে এক মহিলা সাংবাদিক শাহরুখকে প্রশ্ন করে বসলেন, ‘আপনার কি মনে হয় না ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে মারামারি করে বিতর্কে জড়ানোটা আপনার বিরাট ভুল?’ যে কোনও তারকা হলে এই প্রশ্নে তেতে উঠে পাল্টা চারটি কথা শুনিয়ে দিতেন। কিন্তু শাহরুখের উত্তর ছিল, ‘সে কী! আমি তো ভাবতাম রা ওয়ান বানানোটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।’ সারা হল তখন হো হো করে হাসছে। নিজের ব্যর্থতা নিয়ে রসিকতা করতে ক’জন পারে? পরক্ষণেই শাহরুখের উত্তর ছিল, ‘ঠিক ভুল জানি না, তবে আমার বাচ্চাদের দিকে যে হাত উঠবে ভবিষ্যতেও সেই হাত মুচড়ে দিতে আমি দু’বার ভাবব না।’ সন্তানদের প্রতি এই প্রোটেক্টিভ মেন্টালিটি যে পুরুষের, তাঁকে ভাল না বেসে মহিলারা যাবেন কোথায়? এই স্পষ্টবক্তা শাহরুখকেই নারীরা ভালবাসেন, যিনি আকাশকুসুম রোম্যান্সের পাশাপাশি বাস্তবের মাটিতে পা রেখে বলে দিতে পারেন, ‘আগে পয়সা উপার্জন করো, তারপরে জ্ঞানগর্ভ কথা বলো। পকেটে পয়সা না থাকলে জ্ঞানের কথার কোনও মূল্য নেই।’
শাহরুখ খানের ফ্যান কোটি কোটি। কিন্তু সামনাসামনি তাঁকে দেখার সৌভাগ্য সকলের হয় না। যাঁদের হয়েছে তাঁরা জানেন, শাহরুখ বাস্তব জীবনে কতটা বিনয়ী। সাংবাদিক সম্মেলন হোক কিংবা ফ্যান মিট— মহিলা অনুরাগীদের জন্য শাহরুখে ‘ট্রিটমেন্ট’ সবসময় আলাদা। প্রত্যেক মহিলা ভক্তকে যে তিনি স্পেশ্যাল ফিল করানোর চেষ্টা করেন, একথা শাহরুখ নিজেই স্বীকার করেছেন। আর শুধু ভক্ত বা সাংবাদিকই কেন? অতীতের জুহি চাওলা হোক কিংবা বর্তমানের দীপিকা পাড়ুকোন— প্রত্যেকেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন, শাহরুখের সঙ্গে থাকলে তাঁদের মন আনন্দে ভরে ওঠে। সম্প্রতি সানা ফাতিমা শেখ, যাঁর সঙ্গে আমির খানের সম্পর্কের গুঞ্জন নিয়ে গোটা বলিউড তোলপাড়, সেই সানাও বলেছেন, ‘আমি শাহরুখকে ভালবাসি। ভালবাসাটা তারকার প্রতি ভক্তের ভালবাসা নয়, সিনিয়র অভিনেতার প্রতি জুনিয়র অভিনেতার ভালবাসা নয়। একেবারে নিখাদ প্রেম। প্রথম যেদিন জানতে পেরেছিলাম শাহরুখ বিবাহিত, হাউহাউ করে কেঁদেছিলাম। এখন মনে হয়, বিয়ে করতে হবে না, শাহরুখ আমার সঙ্গে একটা সিনেমা করুন। আমি সেটা নিয়েই খুশি থাকব।’
আমির খানের প্রেমিকা শাহরুখ খান সম্পর্কে এই রকম খুল্লমখুল্লা স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন, এ বোধহয় কিং খান ছাড়া আর কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
কবি লিখেছেন, ‘নারী চরিত্র বেজায় জটিল, কিছুই বুঝতে পারবে না।’ আসলে এই গান লেখার সময়ে তো আর শাহরুখ খান বলিউডে পা রাখেননি। নারীর মন যদি এই উপমহাদেশে একজনও বুঝে থাকেন, তিনি শাহরুখ খান ছাড়া আর কেউ নন।