লালবাজারে কলকাতা পুলিসের হেডকোয়ার্টার থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে লালদীঘি। ১৯৮৯ সালের ৪ জুন ভোর চারটে। ভোরের আলো ঠিক মতো ফোটার আগেই কলকাতা পুলিসের সদর দফতরের নাকের ডগায় এক পুলিস অফিসারের চোখে পড়ল ফুটপাথে এক মহিলা শুয়ে রয়েছেন। কলকাতা শহরে ফুটপাথবাসীর সংখ্যা কম নয়। তাঁরা রাতে ঘুমান পথের ধারেই। সেই হিসেবে দৃশ্যটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু মহিলার শুয়ে থাকার ধরনটা দেখে একটু খটকা লাগল ওই অফিসারের। ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখার জন্য কাছে গিয়ে তিনি যা দেখলেন, তাতে কেঁপে গিয়েছিলেন কলকাতা পুলিসের দুঁদে ওই অফিসার। ঘুম নয়, আসলে চিরনিদ্রায় চলে গিয়েছেন ফুটপাথবাসী ওই মহিলা। ভারী কোনও বস্তু দিয়ে থেঁৎলে দেওয়া হয়েছে তাঁর মাথা। পাশেই পড়ে রক্তমাখা একটি পাথর। যার ওজন আনুমানিক ১০ কেজি।
সেই শুরু, একইভাবে খুন করা হয়েছিল। অজানা সিরিয়াল কিলারের আতঙ্কে সন্ধের নামলে রাস্তায় বেরতে ভয় পেতেন কলকাতাবাসী। আর এই আতঙ্কই জন্ম দিয়েছিল কলকাতার সবচেয়ে আলোচিত সিরিয়াল কিলারের। নাম দেওয়া হয়েছিল স্টোনম্যান!
১৯৮৯ সালের ৪ জুন ভোরে যাঁর দেহ পাওয়া গিয়েছিল, পরিচয় খুঁজে জানা গেল মহিলার নাম আলিয়া বিবি। পেশায় চোলাই মদ বিক্রেতা। স্বামীর সঙ্গে ফুটপাথেই থাকতেন তিনি। স্বামী ছিলেন ফলবিক্রেতা। অন্যদিন স্বামীর সঙ্গে শুলেও সেদিন একাই শুয়েছিলেন। মোটিভ ছাড়া খুন হয় না। এক্ষেত্রে মোটিভটা কী? ফুটপাথবাসী কোনও মহিলাকে যে টাকাপয়সার জন্য খুন করা হবে না, তা বলাই বাহুল্য। প্রাথমিকভাবে মনে করা হয়েছিল, বিবাদের কারণেই হয়তো স্বামী খুন করেছেন আলিয়া বিবিকে। প্রচুর জেরাও করা হয়েছিল। পরে কোনও প্রমাণও পাওয়া যায়নি। ধীরে ধীরে ধামাচাপা পড়ে গেল আলিয়া বিবির কেস।
মাথার ভারী পাথর মেরে খুন যে কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, সেটা বোঝা গেল পরের ৪৫ দিনের মধ্যে। স্টোনম্যানের এবারের শিকার একজন ৪০–৪২ বছরের ব্যক্তি এবং একজন কিশোর। দু’জনেই ফুটপাথবাসী দু’জনের মাথায় পাথর দিয়ে মেরে খুন করা হয়েছে। বোঝা গেল, গা ছাড়া দেওয়া যাবে না। দেওয়া যে যাবে না, সেটা প্রমাণ হয়ে গেল পরের তিনমাসে আরও তিনটে খুন হওয়ায়। কখনও শিয়ালদহ কখনও পার্কস্ট্রিট। মোডাস অপারেন্ডি সেই একই— ভারী পাথর মেরে মাথা থেঁতলে দেওয়া। নিহতের পরিচয়ও সেই এক। নিরীহ ফুটপাথবাসী। পেশায় কেউ হতদরিদ্র মজুর, কেউ ভিক্ষাজীবী। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পুলিস তদন্ত চালাতে থাকল। কিন্তু আসল খুনিকে খুঁজে পাওয়া গেল না।
পরপর ছ’টা খুন করার পরে খুনি বোধহয় একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল। সে ফের মাঠে নামল সেপ্টেম্বরে। স্টোনম্যানের শিকার ৩৫ বছরের এক মানসিক ভারসাম্যহীন ভিক্ষাজীবী। ততদিনে সবদিক খতিয়ে দেখে পুলিস এটুকু বুঝতে পেরেছে, এই কীর্তি কোনও একজন ব্যক্তিরই। যেভাবে ভারী পাথর অবলীলায় মাথার ওপরে তুলে একের পর এক শিকারের মাথা গুঁড়িয়ে দেয় সে, তাতে ধারণা করা যায়, স্টোনম্যান একজন শক্তসমর্থ চেহারার পুরুষ। তার উচ্চতাও বেশি। এসবের মধ্যেই একজন ব্যক্তিকে স্টোনম্যান সন্দেহে গ্রেফতার করেছিল পুলিস। পরে দেখা যায়, খুনের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্কই নেই। কেউ কেউ আবার এই কথাও বলেন, ওই ব্যক্তি মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন ছিলেন। এদিকে অজ্ঞাতপরিচয় এই খুনির সামনে কার্যত অসহায় দেখাচ্ছিল পুলিসকে। যদিও তাদের তরফে চেষ্টার খামতি ছিল না। রাত পড়লেই ফুটপাথে পুলিসের টহল কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। পুলিস জানত, স্টোনম্যান পাথর সঙ্গে নিয়ে ঘোরে না, কারণ এইভাবে পাথর নিয়ে ঘুরতে দেখলেই সন্দেহ বাড়ার কারণ আছে। বরং শিকারের কাছাকাছি পড়ে থাকা পাথরকেই হাতিয়ার বানিয়ে নেয়। তাই রাস্তায় বড় কিংবা ভারী পাথর পড়ে থাকলেই সেগুলো সরিয়ে ফেলা হচ্ছিল। পুলিসের ইনফরমারদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো হয়েছিল। পাশাপাশি চলছিল ব্যাপকহারে ধরপাকড়। পুলিসের ধরপাকড় যখন তুঙ্গে তখনই হঠাৎ উধাও হয়ে যায় স্টোনম্যান। ১৯৮৯ এর ৪ জুন থেকে শুরু করে ১৯৯০ সালের মার্চ মাস অবধি ততদিনে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তেরোতে। তারপর থেকে আর স্টোনম্যানের কার্যকলাপ দেখা যায়নি এই শহরে। যদিও পরে সৃজিৎ মুখোপাধ্যায়ের বাইশে শ্রাবণ ছবিতে এই ঘটনাকে ফের তুলে ধরা হয়েছিল। তবে তা অবশ্যই নিজের মতো করে।
কেউ বলেন ধরা পড়ার ভয়ে স্টোনম্যান নাকি খুন করা বন্ধ করে দিয়েছিল। আবার কেউ কেউ মনে করেন, সে ফিরে গিয়েছিল মুম্বইতে। হঠাৎ মুম্বইয়ের নাম কেন? তারও একটা কারণ আছে। ১৯৮৯ সালে কলকাতায় স্টোনম্যানের কার্যকলাপের আগে ১৯৮৫ সালে একই রকমের ঘটনা ঘটছিল মুম্বইতে। সেখানেও একই কায়দায় দু’বছর ধরে একের পর এক খুন করা হয়েছিল ১২জনকে। অনেকেই মনে করেন, স্টোনম্যান কলকাতায় আসার আগে হত্যালীলা চালিয়েছিল মুম্বইতে। সেখানে স্টোনম্যানের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘পাত্থরমার’।
খুনের কায়দা ও অস্ত্র এক। মুম্বইতে ১২, কলকাতায় ১৩। মোট এই ২৫টা খুনের পিছনে কি একই ব্যক্তি? তার পরিচয় কী? কলকাতা ও মুম্বইয়ের মতো জনবহুল শহরে এতদিন ধরে প্রকাশ্যে এতগুলো খুন করার পরেও কেন পাওয়া গেল না একজনও প্রতক্ষ্যদর্শী? কেন অপরাধীর টিকির নাগালও এল না পুলিসের হাতে? তাহলে কি এটাই ভারতের সবচেয়ে বড় ‘পারফেক্ট ক্রাইম’?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর যে দিতে পারত, সেই স্টোনম্যান আজও রহস্যের আড়ালে।
