You are currently viewing সূর্য সেনের স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা:‌ এক বিস্মৃতপ্রায় নায়িকা

সূর্য সেনের স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা:‌ এক বিস্মৃতপ্রায় নায়িকা

Share this post

ইতিহাসের পাতায় লেখা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন। আসলে লেখা উচিত চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার অভিযান। কারণ, নিজের হকের জিনিস পুনরুদ্ধারকে লুণ্ঠন বলা যায় না। সূর্যকুমার সেন যিনি ইতিহাসে সূর্য সেন কিংবা মাস্টারদা নামে পরিচিত, তিনি নিজের হকের পাওনা বুঝে নিয়েছিলেন। হাত কচলে অনুনয়–বিনয়ে নয়। দাপটে। বন্দুকের নলে।
নারী দিবসে সূর্য সেনের কথা কেন? আমরা স্মরণ করছি ইতিহাসের পাতায় বিস্মৃত এক মহিয়সী নারীকে। বিপ্লবী সূর্য সেনের স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা দেবী।
তাঁকে বিয়েটা খুব একটা ইচ্ছা নিয়ে করেননি সূর্য সেন। বরং বিয়ের সময় মাস্টারদা কিছুটা মানসিক দোলাচলের মধ্যে ছিলেন। উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান না থাকায় মাস্টারদার উচ্চশিক্ষার যাবতীয় খরচ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বহন করেছিলেন তাঁর ভাবী শ্বশুরমশাই কানুনগোপাড়ার নগেন্দ্রনাথ দত্ত। মুর্শিদাবাদের কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষা দিয়ে মাস্টারদা ফিরে এলে অল্প কিছু দিনের মধ্যে আত্মীয়রা পুষ্পকুন্তলার সঙ্গে তাঁর বিয়ের সমস্ত আয়োজন করে ফেলেছিলেন। তার আগেই মাস্টারদা ঠিক করে ফেলেছেন যে সংসার নয়, তিনি দেশের কাজটাই করবেন। কিন্তু ভাবী শ্বশুরের প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত এই বিয়েতে অস্বীকৃত হতে পারেননি।
সূর্য সেন যখন বিয়ের আসরে বসে, তখনই খবর পান, তাঁর সহযোগীরা নতুন করে সংগঠন গড়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করার পরিকল্পনা করেছেন। তাঁরা বলেছেন, সূর্য সেনকেই এই সংগঠনের দায়িত্ব নিতে হবে। গৃহীজীবন ত্যাগ করে বিপ্লবের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়া নিয়ে আর কোনও দ্বিধা রাখেননি সূর্য সেন।
বিয়ের বাসর থেকে উঠে সেই রাতেই মনোবাসনার কথা পুষ্পকুন্তলাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বাড়ি ছেড়েছিলেন, যেদিন ফুলশয্যা, সেদিনেই। যাওয়ার আগে ক্ষমা চেয়ে গিয়েছিলেন পুষ্পকুন্তলা দেবীর কাছে। বিয়ের পরে স্বামী সংসার করবে না, সেযুগে এক সাদাসিধা নববধূর কাছে এটা যে কতবড় ধাক্কা, সেটা আঁচ করার ক্ষমতা আমাদের থাকার কথা নয়। এ–ও মনে রাখতে হবে, পুষ্পকুন্তলার বয়স তখন মাত্র ১৬বছর।
সূর্য সেন সংসার ত্যাগের পর একা একাই থাকতেন পুষ্পকুন্তলা। নিজের শরীর স্বাস্থ্যের প্রতি কোনও যত্ন নিতেন না। ঘুরে বেড়াতেন বনেজঙ্গলে। আর পড়তেন সূর্য সেনের পাঠানো চিঠি, বই। উত্তরও দিতেন। শেষ চিঠিতে পুষ্প লিখেছিলেন, ‘তোমার দেওয়া দেবী চৌধুরানী বইটা কাল রাতে শেষ করেছি।’ আঁকাবাঁকা হরফে আরও লেখা, ‘আমি যখন থাকব না, তখন টোনার দিকে একটু লক্ষ্য রেখো।’ টোনা মানে সূর্যের ভাইপো। বড়দা’র ছেলে।
ইতিহাস যতই বলুক, সূর্য সেন তাঁর স্ত্রীর দিকে আর ঘুরে তাকাননি, সেটা বোধহয় ঠিক নয়। নইলে স্ত্রীকে কেন নিয়মিত বই আর চিঠি পাঠাবেন সূর্য? কেন পাঠাবেন শাড়ি, সুগন্ধী আর আংটি? চার বছরের অদর্শন হয়তো সূর্যের মধ্যে একটা প্রগাঢ় ভালবাসার বোধ তৈরি করেছিল। সূর্যের পাঠানো বইগুলোর দিকে নাকি মাঝে মাঝে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতেন তিনি। পাল্টা চিঠিতে লিখতেন, স্ত্রী কি ছাত্রী হতে পারবে না? কেন স্ত্রীর ওপর ভরসা রাখতে পারবেন না তাঁর বিপ্লবী স্বামী? হয়তো এই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর পাননি পুষ্প। তাই সূর্য সেনের বৌদিকে পুষ্প প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আমি কি তোমার মেজোমশাইয়ের কাজে কোনও সাহায্যই করতে পারতাম না দিদি?’ সেখান থেকেও উত্তর না পেয়ে যখন যেখানে স্বামীর কোনও বিপ্লবী বন্ধুকে হাতের কাছে পেয়েছেন, তাঁকেই অনুরোধ করেছেন যাতে তাঁকেও দলে নেওয়া হয়। ন’বছরের বিবাহিত জীবনে মাত্র তিনবার স্বামীর দেখা পান পুষ্পকুন্তলা‌।
১৯২৮ সালে শেষের দিকে পুষ্পকুন্তলার অসুস্থতার খবর পেয়ে সূর্য সেন তাঁকে দেখতে আসার অনুমতি চান। এই আবেদন মঞ্জুর করা হলে তাঁকে নজরবন্দী রাখা হবে এই শর্তে জেল থেকে তিনি ছাড়া পান।
যেদিন জেল থেকে বাড়ি পৌঁছলেন সূর্য, সেদিনই স্বামীর কোলে মাথা রেখে চলে যান পুষ্পকুন্তলা। স্বামী যে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, সেটাও দেখে যেতে পারেননি, কারণ, সূর্য যখন আসেন, টাইফয়েড রোগে জীর্ণ পুষ্পকুন্তলা তখন অচৈতন্য।
পুষ্পকুন্তলার সঙ্গে এই প্রশ্নও চিরতরে চিরঘুমে চলে গিয়েছিল, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্তরা পারলে পুষ্পকুন্তলা দেবী কেন নয়? তিনিও তো স্বামীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইটা লড়তে চেয়েছিলেন।


Share this post

Leave a Reply