‘তারানাথ জ্যোতির্বিনোদ
এই স্থানে হাত দেখা ও কোষ্ঠীবিচার করা হয়। গ্রহশান্তির কবচ তন্ত্রোক্ত মতে প্রস্তুত করি। আসুন দেখিয়া বিচার করুন। বড় বড় রাজা-মহারাজার প্রশংসাপত্র আছে। দর্শনী নামমাত্র।’
এই ক’টা লাইনের হাত ধরেই বাংলা সাহিত্যের নতুন সুপাহিরো তারানাথ তান্ত্রিক। বাংলা সাহিত্য পেয়ে গিয়েছে তার নতুন সুপারহিরো— তারানাথ তান্ত্রিক। খাতায় কলমে নতুন শব্দটা হয়তো খাটে না, কারণ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প লিখতে শুরু করেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪০ সালে। সেই হিসেবে তারানাথ তান্ত্রিকের বয়স ৬২–এর বেশি। তবে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, নতুন করে সানডে সাসপেন্স আর ‘গপ্প মীরের ঠেক’–এর হাত ধরে জনপ্রিয়তার শিখরে উঠেছে অতিলৌকিক এই চরিত্রটি। ফলে নতুন করে শুরু হয়েছে তারানাথ তান্ত্রিককে নিয়ে চর্চা।
কী করে বিভূতিভূষণের মাথায় এল তারানাথ তান্ত্রিকের প্লট? কাকে দেখে তারানাথ তান্ত্রিকের চরিত্রটাকে সাজিয়েছিলে বিভূতিভূষণ? অনেকেই জানেন না, তারানাথ তান্ত্রিকের চরিত্রনির্মাণ বিভূতিভূষণ সম্পূর্ণ মন থেকে গড়েননি। এর নেপথ্যে ছিলেন এক রক্তমাংসের বাস্তব মানু্ষ।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি ছিল তৎকালীন যশোর আর বর্তমানের চব্বিশ পরগনা জেলার বনগাঁয়। ষোড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায় ছিলেন বিভূতিভূষণের বন্ধু। বয়সে ষোড়শীকান্ত বিভূতিভূষণের চেয়ে বেশ খানিটা বড়। একদিকে ষোড়শীকান্তর ততদিনে দু’–একটা বই লিখে ফেলেছেন। অন্যদিকে, বিভূতিভূষণের তখন দেশজোড়া খ্যাতি। পথের পাঁচালী, অপরাজিত, আরণ্যকের মতো উপন্যাস তিনি লিখে ফেলেছেন।
বিভূতি প্রায়ই ষোড়শীকান্তের বাড়িতে যান। থাকেন। সাহিত্য আলোচনা করেন। ষোড়শীকান্তের দুই মেয়ে, মায়া ও কল্যাণী। তাঁদের সঙ্গেও বই নিয়ে আলোচনা হয়। পরে এই কল্যাণীর সঙ্গেই বিভূতিভূষণের দ্বিতীয় বিয়ে হবে।
সে সময় একদিন ষোড়শীকান্তের বাড়িতে এলেন সারদাকান্ত চক্রবর্তী। ইনি ষোড়শীকান্তের বন্ধু এবং ঘটনাচক্রে বিভূতিভূষণেরও পূর্বপরিচিত। দীর্ঘ গৌরবর্ণ দেহ। সারাজীবন দেশবিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। আড্ডায় বসে চমকে দেওয়ার মতো গল্প বলায় পটু। তন্ত্রমন্ত্রে গভীর জ্ঞান। সর্বোপরি ভূতপ্রেত প্ল্যানচেট— এসব নিয়ে ভীষণ উৎসাহ।
সারদাকান্তকে দেখতে দেখতেই তাঁর মধ্যে তারানাথের চরিত্রটি খুঁজে পেলেন বিভূতিভূষণ। এমনকী, সারদাকান্তের পদবি অনুসরণ করেই তারানাথের পদবিও চক্রবর্তীই রাখেন বিভূতিভূষণ। লিখে ফেলেন তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প। তারানাথকে নিয়ে নিজে দু’টি গল্প লিখেছিলেন বিভূতিভূষণ। লেখার সময় অতো ভাবেননি। চিন্তা শুরু হল বই প্রেসে যাওয়ার পরে। এ বই যদি ছাপা হয়, ষোড়শীকান্ত তো বটেই, সারদাকান্তও বুঝতে পারবেন আসলে তারানাথের চরিত্রটি কাকে ভেবে তৈরি করা। ‘তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প’–তে (যা কি না তারানাথ সিরিজের প্রথম কাহিনী) তারানাথের চরিত্র সম্পর্কে বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন, ‘তারানাথের জীবনে তিনটি নেশা ছিল প্রবল–ঘোড়দৌড়, নারী ও সুরা। এই তিন দেবতাকে তুষ্ট রাখিতে কত বড় বড় ধনীর দুলাল যথাসর্বস্ব আহুতি দিয়া পথের ফকির সাজিয়াছে, তারানাথ তো সামান্য গণকার ব্রাহ্মণমাত্র।’ পরে তারানাথের চরিত্রের মুখ দিয়ে এ–ও বলানো হয়েছে যে তারানাথ যৌবনে নিতান্ত নিষ্কাম ব্রাহ্মণ ছিলেন না। গল্পের খাতিরে বলা হলেও ষোড়শীকান্ত ও সারদাকান্ত এসব ভালভাবে নাও নিতে পারেন। সোজাসুজি গিয়ে ষোড়শীকান্তের কাছে গিয়ে বিভূতিভূষণ স্বীকার করে ফেললেন, তিনি কী করেছেন, কী লিখেছেন। ষোড়শীকান্ত এবং সারদাকান্ত কেউই কিন্তু ব্যাপারটায় কিছু মনে করলেন না। বরং উৎসাহই দিলেন। বই ছাপা হয়ে বেরও হল।
এভাবেই বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে গেলেন তারানাথ তান্ত্রিক।
পাঠকমাত্রেই জানেন, তারানাথ তান্ত্রিকের বাড়ি ছিল মট লেনে। কেন মট লেনেই তারানাথকে বসিয়েছিলেন বিভূতিভূষণ, তার পিছনেও রয়েছে নির্দিষ্ট এক কারণ। মট লেনের নামকরণ করা হয়েছিল জনৈক মট সাহেবের নামে। কে এই মট সাহেব? কেনই বা তিনি বিখ্যাত? আসলে এই মট ছিলেন রবার্ট ক্লাইভের আমলের এক ধনী ব্যবাসীয়। জানলে অবাক হবেন, কলকাতার পুলিস সেই আমলে অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করতো। এই মট সাহেবের উদ্যোগে কলকাতা পুলিসে অপরাধী ধরার জন্য চালপড়া পদ্ধতির প্রচলন করেন। এই কাজের জন্য চালপড়া বিশেষজ্ঞদেরও রাখা হয়, যাদের বলা হতো পুলিস মুন্সি। অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী তারানাথের বাড়ি হিসেবে তাই অলৌকিকতার সঙ্গে নাম জড়িয়ে থাকা মট লেনকেই বেছে নেন বিভূতিভূষণ।
প্রাচীন শাস্ত্র ও তন্ত্রবিদ্যা সম্পর্কে বিভূতিভূষণের পড়াশুনো নেহাত কম ছিল না। তবু তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প লিখতে গিয়ে বেশ কিছু বিচ্যুতি রয়ে গিয়েছে বিভূতিভূষণের। কীরকম? এক এক করে দেখে নেওয়া যাক। প্রথম গল্পে মাতু পাগলী তারানাথকে দু’বার শবসাধনার নির্দেশ দেন। একবার তাঁর নিজের শবের ওপরে, দ্বিতীয়বার নদীর জলে ভেসে আসা একটি তরুণীর শবের ওপরে। কিন্তু, স্ত্রীলোকের শব নিয়ে সাধনা তন্ত্রশাস্ত্রে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। বৃহৎ তন্ত্রসারে ভৈরবতন্ত্রবচনে রয়েছে— ‘স্ত্রীজনঞ্চেদৃশং রূপং সর্ব্বথা পরিবর্জয়েৎ’। আরও আছে। দ্বিতীয় গল্পে তারানাথের গুরু তাঁরও গুরু কালীকানন্দ ব্রহ্মচারীর কথা বলছিলেন। কালীকানন্দ নাকি বলেছিলেন যে, ভূতডামর তন্ত্রের প্রথম শ্লোকই হল “অথাত: সংপ্রবক্ষামি যোগিনীসাধনমুত্তমম্” ইত্যাদি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি ভূতডামরের ষোলো নম্বর পটলের প্রথম শ্লোক।
আরও দেখা যাক। গল্প অনুযায়ী তারানাথকে কৃপা করেছিলেন মধুসুন্দরী দেবী। কে এই মধুসুন্দরী দেবী? ভূতডামরে মধুসুন্দরী দেবীর কথা কোথাও নেই। আছেন মধুমতী দেবী। ভূতডামরের পাশাপাশি চৈতন্যভাগবতেও এই মধুমতী দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। আবার নিগমামন্দ ঠাকুরের ‘তান্ত্রিক গুরু’ বইতেও তাঁর উল্লেখ আছে। এবার সমস্যাটা হল, তারানাথের মধুসুন্দরী দেবীর ধ্যান ও জপমন্ত্রের সঙ্গে আবার ভূতডামরের মধুমতী দেবীর ধ্যান ও জপমন্ত্র মেলে না। পূজোর পদ্ধতি আর ফলাফলও অনেকটা আলাদা। সম্ভবত ভূতডামরে উল্লেখ করা সুরসুন্দরী দেবী আর মধুমতী দেবীর নাম মিশিয়ে বিভূতিভূষণ নিজেই মধুসুন্দরী দেবীর সৃষ্টি করেছিলেন।
তবে এইটুকু তথ্য এদিকওদিক করার স্বাধীনতা তো যে কোনও লেখকেরই থাকা উচিত। তা না করলে আর তারানাথ তান্ত্রিক কালজয়ী হবেন কী করে?
